
নাস্তিকতা থেকে ইসলামের ছায়ায়
মাওলানা আব্দুল মাজীদ দরিয়াবাদী রহ.
নাস্তিকতার সূচনাএকটি ধার্মিক সম্ভ্রান্ত পরিবারে আমার জন্ম এবং ধর্মীয় পরিবেশেই প্রতিপালন হয়। বড় বোনকে নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তে দেখেছি। আম্মাজানও নামায-রোযার প্রতি যত্নবান ছিলেন এবং ছিলেন বড় ধর্মপ্রাণ। বড় ভাইও একেবারে বেনামাযী কিংবা ধর্মবিরোধী ছিলেন না। আমাদের পরিবারে ধার্মিকতার পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চা ও অনুশীলন ছিল। দাদাজান বিদগ্ধ ফকীহ ও মুফতী ছিলেন। নিয়মিত ফতোয়াও প্রদান করতেন। নানাজানের দীনি জ্ঞানগরিমা এবং ধর্মীয় কীর্তি ও অবদানের খ্যাতি জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই শুনে আসছিলাম। চাচাজান একেবারে শৈশবকাল থেকেই লেবাস-পোশাক সম্পূর্ণ মৌলিবিয়ানা করে দিয়েছিলেন। ছোট্ট দেহে ছোট্ট জুব্বা। মাথায় চন্দন কালারের বড় পাগড়ি। হাতে বড় দানার তাসবীহ। পড়া-শোনার কিতাবাদির অধিকাংশই ধর্মীয় রঙের। গৃহশিক্ষক হলেন একজন মৌলবি সাহেব। পাঠশালার আরবী-শিক্ষক হলেন একজন হাজী সাহেব। উভয়ের সান্নিধ্য সোনায় সোহাগার কাজ করছিল।
১২/১৩ বছর বয়সে যখন সপ্তম শ্রেণিতে পৌঁছলাম, তখন তো বলতে গেলে একেবারে একপ্রকার মৌলবিই ছিলাম, এমনকি কিতাবাদি পড়ে পড়ে সেগুলোর বিষয়বস্তু চুরি করে করে আর্যসমাজ, খ্রিস্টান মিশনারী ও নেচারীদের বিরুদ্ধে বড়-সড় প্রবন্ধ রচনা শুরু করলাম। এ কথাও মনে পড়ে ওই বয়সে দেশের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত ও ধর্মবিদ এমনকি মুজাদ্দিদ মনে করতাম মাওলানা আব্দুল হাই ফিরিঙ্গি মহল্লীকে। তার তিরোধানের ২৫-২৬ বছর গত হওয়া সত্ত্বেও হৃদয়ে তাঁর গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা দাগ কেটেছিল। মাওলানা মুহাম্মদ আলী রহমানী মুঙ্গেরীর প্রভাবে খ্রিস্টবাদ খ-নে এবং মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর প্রভাবে আর্যসমাজের ফেতনার মোকাবেলায় তনুমনে নিয়োজিত ছিলাম। নবম শ্রেণিতে উঠে বাতিল ফেরকাগুলো নিয়ে বিতর্কের মনোভাব আরও চাঙ্গা হলো। ইতিমধ্যে উপমহাদেশের বিদগ্ধ মনীষী আল্লামা শিবলী রচিত আলকালাম, রাসায়েল ইত্যাদি গ্রন্থের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এতে দর্শন ও ইলমে কালামের প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হলো। আর খ্রিস্টবাদ ও আর্যসমাজের মোকাবেলার পরিবর্তে নাস্তিক ও বস্তুবাদীদের মোকাবেলায় মনোযোগ নিবদ্ধ হলো। তখনো জামাতের সহিত নামায এবং রোযা পালনসহ অন্যান্য ধর্মীয় বিধি-বিধানের প্রতি যত্নবান ছিলাম।
ধর্মীয় জোশ ও উদ্দীপনার এই ভাবাবেগ নিয়ে যৌবনের ষোড়শ বৎসরে পদার্পণ করলাম। সীতাপুর হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে প্রাদেশিক রাজধানী লখনৌ চলে এলাম। জুলাই ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে কেনিঙ্গ কলেজে ভর্তি হলাম। ভর্তির কিছুকাল আগেই লখনৌ এসে গিয়েছিলাম। সেখানে এক আত্মীয়ের কাছে একটি ইংরেজি গ্রন্থ নিছক ঘটনাক্রমে চোখে পড়ে গেল। বেশ বড়সড় সাইজের গ্রন্থ। সব ধরনের গ্রন্থ পড়া ও পড়ে শেষ করে ফেলার ‘ব্যাধি’ তো আগে থেকেই ছিল, যাকে বলে গ্রন্থকীট। অনায়াসে ওই গ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করলাম। কিন্তু এ কী হলো! কী ঘটতে শুরু করল! কীভাবে ভাষায় ব্যক্ত করব। অধ্যয়ন যতই অগ্রসর হচ্ছিল ততই যেন যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে লাগল। আকাইদ ও আখলাক এবং প্রাচীন বিশ্বাস ও সর্বজনীন মূল্যবোধের পুরো জগতে প্রচ- ভূকম্পনে সবকিছু তছনছ হয়ে যেতে লাগল!
গ্রন্থটা ধর্মবিষয়ক ছিল না। সমাজ ও সামাজিকতার নীতিমালা ছিল গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়; Element Of Social Science এই মুদ্রণে গ্রন্থকারের নাম ছিল অনুপস্থিত। নামের পরিবর্তে শুধু তার ডাক্তারী ডিগ্রি এম. ডি লেখা ছিল। পরবর্তী মুদ্রণগুলোতে নাম এল ডাক্তার ড্রেসডেল। আরও পরে প্রকাশ পেল সে আপন যুগের কট্টর নাস্তিক ছিল। তার বই তো বই নয় যেন বারুদ বিছানো সুড়ঙ্গ। আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল ওইসব নৈতিক ও সর্বজনীন মূল্যবোধ ও বিধিনিষেধ, যা ধর্মপ্রাণ মানুষ আজ পর্যন্ত প্রচলিত ও স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান ও সর্বজনীন মূল্যবোধ হিসেবে আঁকড়ে ধরে রেখেছে এবং এসবকে ধর্মীয় বিধান ও নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। যেমন : নারীর জন্য সতীসাধ্বী হওয়া এবং পুরুষের জন্য আপন যৌবনকে নিষ্কলুষ ও নির্দাগ রাখা। বইয়ের আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল এ ধরনের মহামূল্যবান মূল্যবোধগুলো।
তার দাবি ছিল―যৌনকামনা তো দেহের একটি স্বভাব-দাবি। একে দমন করা, এর জন্য নিয়মতান্ত্রিক বিবাহের অপেক্ষায় থাকা শুধু নিরর্থক কাজই নয়, বরং স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর আর যৌনশক্তি ও অন্যান্য দৈহিক শক্তির স্বাভাবিক বৃদ্ধির পথে কঠিন অন্তরায়। তাই এ ধরনের সমস্ত বাধা ও অর্গল ভেঙ্গে ফেলো। ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের স্বরচিত জীবন-বিধান পদদলিত করো―এখানে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করা হলো। এভাবে বইটার প্রতিটি আঘাত সব শেষ এসে পড়ত প্রত্যেক এমন মূল্যবোধের উপর যা সর্বদাই ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছে। মালথেসের জন্মনিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাতের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তার আলোচনা সর্বপ্রথম এই বইয়ে পড়ার সুযোগ হয়। আলোচনার শৈলী ছিল বড় জোরদার ও বক্তৃতাসুলভ। ষোড়শ বর্ষীয় এক অনভিজ্ঞ বালক এই মহাপ্লাবনের সামনে আপন ঈমান ও আখলাক এবং বিশ্বাস ও মূল্যবোধের জীর্ণ-শীর্ণ কিশতিকে কীভাবে নিরাপদ রাখতে পারবে। বিশেষত বইয়ের আহ্বান ও প্রচারণা যখন হয় সম্পূর্ণ প্রবৃত্তি ও কামনা মোতাবেক।
ধর্মের পক্ষাবলম্বন ও ধমদ্রোহীদের প্রতিরোধের যে উৎসাহ-উদ্দীপনা অন্তরে সঞ্চিত ছিল, তা এই প্রচ- বোমাবর্ষণ সহ্য করতে পারল না। ফলে ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দ্বিধা ও সংশয়ের বীজ রোপিত হয়ে গেল (আল্লাহ ক্ষমা করুন)। ভাবতে লাগলাম আজ পর্যন্ত কেমন ধোঁকায় পড়েছিলাম, প্রথাগতভাবে যেসব বিষয়কে বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ স্থির করে রেখেছিলাম, তা যুক্তি-বুদ্ধিনির্ভর সমালোচনার মুখে কীভাবে কর্পুরের মতো মিলিয়ে গেল। কতটা দুর্বল ও অন্তঃসারশূন্য সাব্যস্ত হলো। এটাই ছিল ওই বিষক্রিয়া যা বই সমাপ্তির পর মন-মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে নিচ্ছিল―সফল ও স্বার্থক প্রোপাগাণ্ডা ও অপপ্রচার হলো―লক্ষ্যবস্তুর ওপর সরাসরি ও প্রত্যক্ষ আক্রমণ না করা; বরং লক্ষ্যবস্তুর আশপাশে কামান দাগিয়ে দুর্গের অবস্থা এতটাই ক্ষতবিক্ষত ও জীর্ণ-শীর্ণ করে ফেলা যে স্বয়ং দুর্গরক্ষী ও প্রতিরোধকারীদের অপরাজেয় মনোভাবও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। আর তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রতিরোধ ছেড়ে অস্ত্রসমর্পণ করে বসে।
দ্বিধা ও সংশয়ের এই বীজ তো রোপিত হয়েই গিয়েছিল, ঠিক সেই সময়েই লখনৌর গ্রন্থাগারে International Library Of Famous Literature নামে কয়েক খণ্ডের বড়সড় একটি গ্রন্থ নজরে পড়ল এই গ্রন্থটাও ধর্মসম্পর্কীয় নয়। নির্বাচিত সাহিত্য ও প্রবন্ধমালার সমগ্র। সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বাছাই করে এতে একত্র করে দেওয়া হয়েছে। এর এক খণ্ড কোরআন ও ইসলাম সম্বন্ধে। প্রশংসা যদিও নেই তবে বিশেষ কোনো নিন্দা ও সমালোচনাও তাতে ছিল না। তবে এই খণ্ডের পুরো এক পৃষ্ঠাজুড়ে ‘বানীয়ে ইসলাম-ইসলামপ্রবর্তক’ এর একটি ছবি দেওয়া হয়েছিল। মধ্যম গড়নের একজন মানুষ। আর নিচে এই উদ্ধৃতি দেওয়া আছে যে, অমুক হস্তশিল্পীর অঙ্কিত চিত্রের ফটোকপি এই ছবি। যেন সব ধরনের সন্দেহ-সংশয়ের ঊর্ধ্বে। অনাচারী শিল্পী এক বেদুঈনের গায়ে জুব্বা, মাথায় পাগড়ি, মুখম-লে কোনো প্রকার নম্রতা ও কোমলতার পরিবর্তে রুক্ষতা ও কর্কশতার ছাপ এঁকে দিয়েছিল। হাতে ধনুক, কাঁধে তূণীর। বাজুবন্ধে তরবারি। নাউযুবিল্লাহ। পুরো চিত্রটাই যেন এক দুর্ধর্ষ নিষ্ঠুর প্রকৃতির বেদুঈন সরদারের। আল্লাহ না করুন, এখন যদি এ ধরনের কোনো চিত্র দৃষ্টিগোচর হয়, তাহলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মুখ দিয়ে আস্তাগফিরুল্লাহ বেরিয়ে যাবে! বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে এই কাল্পনিক চিত্রের কোনো দূরতম সম্পর্কও ছিল না। হাদীস শরীফে তো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, লেবাস-পোশাকসহ প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি বিবরণ রয়েছে। হাদীসের বিবরণের সঙ্গে এই চিত্রের কোনো দূরতম সাদৃশ্যও ছিল না। নিশ্চিতই এটা কোনো শয়তানী মস্তিষ্কের কারসাজি। তখন সেই হুঁশ-জ্ঞান আর কোত্থেকে থাকবে! প্রচ- আঘাত যুগপৎ মন ও মস্তিষ্কে হানল। ভেতর থেকে আওয়াজ এল তওবা করো। কেমন ধোঁকায় পড়ে ছিলে। দয়া-মায়া, নম্রতা, উদারতার সমস্ত কাহিনি অন্তঃসারশূন্য প্রমাণিত হল। এই না সাক্ষাৎ পাওয়া গেল প্রকৃত সত্যের!
ইউরোপের নামে বাতিকগ্রস্ত মানসিকতা এই কল্পনাও করতেও অক্ষম ছিল যে স্বয়ং এ চিত্রেই কোনো কারসাজি ও জালিয়াতি আছে এবং এ গ্রন্থকারের কথাও মিথ্যা হতে পারে। তাহকীক ও অনুসন্ধান হোক না-হোক কথা সেটাই সত্য যা চিত্র থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে। কোনো আর্যসমাজী, কোনো খ্রিস্টবাদী কিংবা অন্য কোনো ইসলামের শত্রুর সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে পরাজিত হওয়া ছাড়াই বছরের পর বছরের মেহনত, পরিশ্রম ও অতি যত্নে গড়া দুর্গ এভাবে মুহূর্তেই তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ল। রাসূল হিসেবে নবীজীর সত্তার ব্যাপারে শ্রদ্ধাপূর্ণ স্বতন্ত্র বিশ্বাস, রাসূল হিসেবে নবীসত্তার অর্থ এমনকি একজন মহামানব কিন্তু শ্রেষ্ঠতম মানব হওয়ার ধারণাটাও ধীরে ধীরে হৃদয় থেকে তিরোহিত হয়ে গেল। ঈমান ও ইসলামের সুমহান দৌলত সামান্যতেই চরম ধীকৃত ধর্মদ্রোহিতায় পর্যবসিত হলো―আমার আত্মজীবনীর এ অংশটুকু প্রতিটি মুসলমানের গভীর চিন্তা-ভাবনা করে পড়া উচিত। ধর্মীয় পরিবেশে লালিত-পালিত, ধর্মীয় আবহে বেড়ে উঠা কিশোর―বলা ভালো ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠা যুবক―শয়তানের প্রাথমিক দু-এক দফার আক্রমণে কত সহজেই ধরাশায়ী হয়ে পড়ল। ভ্রষ্টতার কত অসংখ্য দরজা খুলে রাখা হয়েছে। আর শয়তান হানা দেওয়ার কত অসংখ্য পথ তৈরি করে রাখা হয়েছে! অবস্থা এতদূর গড়ানোর পর নামায-রোযার অস্তিত্ব আর কীভাবে থাকতে পারে!
প্রথমে নিয়মিত থেকে অনিয়মিত হলো। নামাযের প্রতি যত্ন ও পাবন্দি ছুটে গেল। নামায ছুটতে শুরু করল। একাধারে কয়েক ওয়াক্ত ছুটতে লাগল। এমনকি একসময় একেবারেই ছুটে গেল। ওযু, তেলাওয়াত, রোযা―এসবের সঙ্গেও আর কোনো সম্পর্ক রইল না। প্রথম প্রথম আব্বাজানের কিছুটা ভয় ও লেহাজ ছিল, কিন্তু তা আর কতক্ষণ কাজে দেওয়ার! লখনৌ থেকে যখন সীতাপুর তাঁর কাছে যেতাম, তখন নামাযের সময় হলে তার কাছ থেকে কেটে পড়তাম। এদিকে-সেদিক সরে পড়তাম। কখনো কখনো ঘুমের ভান করতাম। জুমার নামাযের বিষয়টি বড় কঠিন হয়ে দাঁড়াল। প্রথম প্রথম আব্বাজান আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। আমি অপদার্থকে যখন উঠাতেই পারতেন না, আর সময়ও শেষ হওয়ার উপক্রম হতো, তখন তিনি আমাকে আপন অবস্থায় রেখে মসজিদে চলে যেতেন। হৃদয়ের কী অবস্থা নিয়ে যেতেন―এখন এটা কে বলতে পারবে?
আজ যখন বসে বসে ভাবি, আল্লাহর এই বান্দা আমি অপদার্থের কাছ থেকে কী নির্মম আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন, তখন মনে হয় আমার দুর্ভাগ্যে ভূমি প্রকম্পিত হচ্ছে, আকাশ গর্জন করছে। কিন্তু বলাবাহুল্য, আমি যেহেতু আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণেও প্রস্তুত ছিলাম, তখন বাপ বেচারাকে আর কেয়ার করব কেন? ধর্মবিষয়ক অধ্যয়ন তখনো এতটা কম ছিল না, কিন্তু ইউরোপীয় নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহের যে মহাপ্লাবনের সঙ্গে সংঘর্ষ ছিল, তাকে মোকাবেলা ও প্রতিরোধের জন্য ওই অধ্যয়ন যথেষ্ট ছিল না।
উপাদান চতুষ্টয়ে গড়া প্রাকৃতিক মহাজগতের মহাকর্মশালায় মহাজগতের স্রষ্টা আপন প্রাকৃতিক বিধানের ক্ষেত্রে কারও প্রতি সামান্যতম লেহাজ করেননি, নিজ প্রেরিত ও অবতীর্ণ ধর্মের পর্যন্তও না। আপন ঘর মসজিদেরও না, আপন গ্রন্থ কোরআন শরীফেরও না, আপন সম্মানিত গৃহ কাবারও না, আপন নবী-রাসূল পর্যন্ত কারও-ই না। শাণিত তরবারিতে যে ধার রেখেছেন তা সর্বত্রই নিজের কারিশমা দেখাবে। পবিত্র গ্রন্থের ওপরেও, মসজিদের মেহরাব মিম্বরেও, কাবার দ্বার ও দেয়ালেও, অলী ও সিদ্দীকের দেহেও―এমনকি মহাসম্মানিত নবীর পবিত্র দেহেও!
پیش ایں فولاد اس پر میا
کز بریدن تیغ رانبود حیا
ধাতব লৌহের চাপায় বড় নেককার মানুষকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতে নিষ্ঠুর তরবারির সামান্যতমও বাধে না।
নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহ
কলেজে এসে প্রথমে যুক্তিবিদ্যা, তারপর দর্শনের প্রতি গভীর মনোযোগী ছিলাম। যুক্তিবিদ্যা তো কলেজ-কোর্সের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন কোর্সে অন্তর্ভুক্তই ছিল না তখনো অর্থাৎ স্কুল যুগ থেকেই তা লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া শুরু করি। আমি সীতাপুর হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তাম আর ভাইজান তখন লখনৌতে এম.এ-র শিক্ষার্থী। দীর্ঘ ছুটিছাটা কাটাতে যখন সীতাপুর আসতেন, তখন তার কোর্সের বই Stocks Logic নিয়ে পড়া শুরু করতাম। উল্টা-সিধা একরকম বুঝেও নিতাম। যুক্তিবিদ্যার প্রাথমিক গ্রন্থ, প্রাথমিক যুক্তিবিদ্যা এবং উচ্চতর যুক্তিবিদ্যাও অধ্যয়ন করে ফেলি। কলেজে এসে এই নেশা পূরণেরও সুযোগ হয়ে গেল। যুক্তিবিদ্যার কোর্সভুক্ত বই-পুস্তক ছাড়া যুক্তিবিদ্যার অন্যান্য আরও বহু গ্রন্থ কলেজ-লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়তে শুরু করি। এমনকি মিল এর বড় সাইজের সূক্ষ্মগ্রন্থ সিস্টেম অফ লজিকও একপ্রকার চেটেপুটে পড়ে নিলাম। অথচ এটা যতখানি যুক্তিবিদ্যার নয়, তারচেয়ে বেশি দর্শনশাস্ত্রের। এখান থেকে প্রত্যক্ষভাবে দর্শনচর্চা ও দর্শনশাস্ত্রের অধ্যয়নও শুরু হয়ে গেল। বিশেষ করে দর্শনের অন্যতম শাখা সাইকোলজি ও মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা। সাইকোলজির বিভাগ সাইন্সের শাখা হিসেবে ছিল না, দর্শনের শাখা ও বিভাগ হিসেবেই ছিল। আর স্বয়ং এরই কয়েকটা শাখা ও বিভাগ ছিল। ব্যক্তি-মনোবিজ্ঞান ছাড়া সামাজিক মনোবিজ্ঞান, মর্জিমনোবিজ্ঞান-সাইকোলজি ইত্যাদি―নাস্তিক কিংবা প্রায় নাস্তিক দার্শনিকদের ইংরেজি গ্রন্থের অভাব নেই। খুঁজে খুঁজে বাছাই করে করে তাদের গ্রন্থ ভালো করে পড়েছি। মিল এর গ্রন্থ তো পাঠতালিকার শীর্ষে ছিল। তখন সংশয়বাদ ও উপযোগবাদী ধ্যান-ধারণা দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলাম। হুয়ূম ও স্পেনারের রচনাবলি চেটেপুটে পড়ে ফেলেছিলাম।
কিছু এমন লেখকও ছিল যারা মূলত বিজ্ঞানী। তবে নাস্তিক দার্শনিক ছাড়াও শুধু কট্টর নাস্তিকদেরও খুব সমীহ করেছি। যেমন : বৃটেনের চার্লস ব্রেডল, জার্মানীর বুশনার এবং আমেরিকার এঙ্গরসৌল। বলাবাহুল্য, এদের লেখা ও রচনা পড়াশোনার দ্বারা আপন সংশয়বাদ আরও হৃষ্টপুষ্ট হতে থেকেছে এবং নাস্তিকতা আরও জোরালো ও বেগবান হওয়ার পথ পেয়েছে। কিন্তু ঈমান ও ইসলাম থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া এবং সরাসরি কুফর ও ধর্মদ্রোহের অঙ্গনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নাস্তিক এবং প্রায় নাস্তিক লেখকদের রচনা এতটা প্রভাব ও ক্রিয়াশীল প্রমাণিত হয়নি যতটা ওইসব শাস্ত্রীয় রচনাবলি প্রমাণিত হয়েছে, যেগুলো মনোবিজ্ঞান বিষয়ে মনোবিজ্ঞানীদের হাতে রচিত ছিল। বাহ্যত ধর্মের সঙ্গে এগুলোর কোনো যোগসূত্রই ছিল না। নেতিবাচকও না, ইতিবাচকও না। আসল বিষ ওইসব বাহ্যিক নিরামিশ শ্রেণির রচনাবলিতে একেবারে খোলামেলা পাওয়া গেছে। যেমন ড. মাডেসলি (Maudesley) নামে এক ব্যক্তি গত হয়েছে। তার বড়সড় ও মোটা সাইজের দুটি গ্রন্থ সে যুগে বিপুল খ্যাতি লাভ করেছিল―
এক. Mental Physiology(মানসিক শরীরবৃত্ত)
দুই. Mental Pathology(মানসিক রোগবিজ্ঞান)
শেষোক্ত গ্রন্থটিতে মানসিক বৈকল্য ও মানসিক রোগের বিবরণ দিতে দিতে একপর্যায়ে এই নরাধম দৃষ্টান্ত হিসেবে মুহাম্মদী ঐশীবাণীকে নিয়ে এল। এই মহামানবের প্রতি অবিচার করে এই জালেম লিখে ফেলে―মানসিক বৈকল্যের শিকার ব্যক্তির পক্ষে এ বিষয়টি খুবই সম্ভব যে সে জগদ্বাসীর জন্য বিরাট কীর্তি ও অবদান রেখে যাবে! ঈমান ও বিশ্বাসের ভিত্তিমূল পূর্বেই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের নরাধম ‘শাস্ত্রবিদ’দের মুখে এমন অতুলনীয় গবেষণাজাত অমৃতবচন শুনে অবশিষ্ট ঈমানটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল। নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহ ষোলকলায় পূর্ণ হলো।
ঈমান ও ইসলামের তরে প্রাণউৎসর্গকারী প্রিয় ভাই ও বোনেরা! আমার এই দ্ব্যর্থহীন স্বীকারোক্তিগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পাঠ করুন। একটু থামুন। চিন্তা করুন। যে শিক্ষার নরককুণ্ডে আপনারা কলিজার টুকরো সন্তানদের ঠেলে দিচ্ছেন, তা তাদের কোথায় নিয়ে যাবে।
ইন্টারমিডিয়েটের শিক্ষার্থী ছিলাম, ধর্মহীনতাকে ভর করে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলাম, ইতিমধ্যে লন্ডন রেশনালিস্ট পারবাস এসোসিয়েশন (RPA) এর প্রকাশিত মহামূল্যবান গ্রন্থরাজির সূচিপত্র জনৈক ব্যক্তির নিকট দেখতে পেলাম। যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এবং বহু প্রত্যাশিত পরম আরাধ্য বস্তু পেয়ে গেলাম। যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যানধারণা প্রচারের নামে এসব গ্রন্থ ধর্মদ্রোহ ও নাস্তিকতা বিস্তারেই বেশি ভূমিকা রাখছিল। এগুলোর সরাসরি ও প্রত্যক্ষ আঘাত যদিও খ্রিস্টবাদের ওপরই পড়ত, কিন্তু কোনো ধর্মই তাদের আক্রমণের বাইরে নিরাপদ ও সংরক্ষিত ছিল না। প্রতিটি গ্রন্থ ছয় আনাতেই পাওয়া যেত। সুলভতার সেই যুগে এতটা সুলভতা বড়ই আশ্চর্যজনক ছিল।
প্রথম প্রথম এসব বই ধার নিয়ে নিয়ে পড়তে হয়েছে। পরবর্তীতে যখন ঝোঁক সৃষ্টি হয়ে গেল এবং নেশা আরও তীব্র হলো, তখন ফিস প্রদান করে সংগঠনের নিয়মতান্ত্রিক সদস্য হয়ে গিয়েছি। যখন অনেক বইয়ের একটি সংগ্রহশালা তৈরি হয়ে গেল, তখন গর্বভরে নিজেকে রেশনালিস্ট-যুক্তিবাদী বলে পরিচয় দিতাম। এ নিয়ে খুব গৌরববোধ করতাম এবং এই ছোটখাট গ্রন্থাগারটিতে চোখ বুলিয়ে খুশিতে বাগ বাগ হয়ে যেতাম। ভারতে এই সংগঠনের কোনো শাখা ছিল না। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সংগঠনের অর্ধমাসিক মুখপত্র রেশনালিস্ট রিভিউ কিংবা লিটারেরী গাইড এর কার্যালয়ে পত্রিকার অগ্রিম মূল্য পাঠিয়ে তার গ্রাহক হয়ে গিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে ইসলামের নাম নিতেও লজ্জাবোধ করতে লাগলাম। ইন্টারমিডিয়েটের বার্ষিক পরীক্ষার সময় যখন হলো তখন পরীক্ষা ফরমে ধর্মবিষয়ক খালি ঘরে মুসলিম লেখার পরিবর্তে শুধু ‘রেশনালিস্ট’ লিখেছি।
চিন্তাগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরোপুরি ইউরোপীয় কিংবা বিলেতি হয়ে গেলাম। এ পর্যায়ে স্বভাবতই মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা কমে যেতে থাকল। ইসলামী সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে গমনাগমন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। বড় হিত প্রমাণিত হলো এটিই অর্থাৎ আপন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন বদুস্তুর ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে কায়েম ছিল। আমার সঙ্গীদের একজন ওই সময়ই আপনজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরোপুরি অন্যদের সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছিল। পোশাক-আশাক চলাফেরা সম্পূর্ণ হিন্দুয়ানি করে ফেলেছিল। আমি নিজের খানাপিনা লেবাস-পোশাক এবং সাধারণ সামাজিকতায় বরং বলা ভালো একটা সীমা পর্যন্ত ভাবাবেগের দিক থেকেও মুসলমানই রয়ে যাই। অবশ্য একজন সুশীল ও প্রগতিবাদী নামধারী মুসলমান।
আর তখনকার নওজোয়ানদের প্রগতিবাদী নামধারী মুসলমান কে না চেনে? আর আলহামদুলিল্লাহ মুসলিম সম্প্রদায় থেকে আমার শেকড় তখনো পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। দীনে ইসলামের পরে মুসলিম জাতীয়তার নেয়ামতও এক বিরাট নেয়ামত। কেউ যেন এই নেয়ামতকে বেকার মূল্যহীন মনে না করে। ভবিষ্যতে এ সামান্য নেয়ামতটিই আমার কাছে বড় মূল্যবান মনে হয়েছে। প্যান্ট-শার্ট যা পরেছি তাতে কোনো নতুনত্ব ও অভিনবত্ব ছিল না। এটুকু সকলেই পরত। যাত্রা-থিয়েটারে যতটা গিয়েছি ততটা সকলেই যেত। অবশ্য কখনো মদ পান করিনি, তবে বার বার এটি পরীক্ষা করার স্বাদ মনে জেগেছে। যদি পান করেও নিতাম তবুও তা অবাক হওয়ার মতো কিছু হতো না। মোটকথা এমন কোনো বিষয় ঘটেনি যার দ্বারা সম্পূর্ণ সমাজচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো শ্রেণি আমাকে বয়কটে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
বড় কথা হলো―কখনো এমন কোনো উক্তি করিনি যার দ্বারা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। যা-ই বলেছি ইলমী ও একাডেমিক পরিধির ভেতরে থেকে মূল বিষয় নিয়ে বলেছি। সমালোচনা যখন করেছি তখনো আকীদাগত বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেছি। কোনো ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বকে কখনো সমালোচনার পাত্র বানাইনি। ভাবাবেগের দিক থেকে অনেকটা মুসলমান রয়ে যাওয়ার ধারাক্রমে এ মজার বিষয়টিও শোনার মতো যে কোনো অমুসলিম যখন ইসলাম সম্পর্কে কোনো আপত্তি করত, তখন তার পক্ষ নিতে এবং সহায়তা করতে হৃদয় সাড়া দিত না। বরং পূর্ণ নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহের কবলে থাকা সত্ত্বেও অন্তর প্রতিউত্তর দিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসত।
অক্টোবর ১৯১১ এর ঘটনা। খ্রিস্টানদের একটি বড় কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য চরম ইসলামবিদ্বেষীখ্যাত পাদরি যোয়মের (Zuemer)ও বাহরাইন থেকে এসে উপস্থিত হলো। তার ইসলামবিদ্বেষের খ্যাতি তার আগমনের পূর্বেই এ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি বি.এ-র শিক্ষার্থী ছিলাম। বিশ্বাস ও আদর্শগতভাবে পুরোপুরি ইসলামবিরোধী। আপন এক বন্ধু মাওলানা আব্দুল বারী নদভীকে সঙ্গে করে চট করে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। সাক্ষাতে পাদরি সাহেব খুব ভদ্র ও বিনীত আচরণ করলেন। কিন্তু অভ্যাসবশত কথাবার্তায় ইসলামের ওপর আক্রমণ করতে থাকলেন। প্রিয় পাঠক, বিশ্বাস করুন, নদভী সাহেব যে-ই পাদরিকে আরবীতে প্রতিউত্তর দিতে লাগলেন তদ্রূপ আমিও ইংরেজিতে তার জবাব দিতে শুরু করলাম। পাদরি সাহেব কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না যে আমি তো নিজেই ইসলামত্যাগী মুরতাদ (তবুও কেন ইসলামের পক্ষ নিয়ে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি।) কোনো পাদরি কিংবা আর্যসমাজী অথবা কোনো প্রকাশ্য ইসলামবিরোধীর কোনো প্রভাব একেবারেই আমার উপর ছিল না। যতটা প্রভাবিত হয়েছিলাম তার সবই ছিল ইসলামের গোপন শত্রুদের দ্বারা। তাদের জ্ঞান-গরিমা ও পাণ্ডিত্য, তাদের উন্নত গবেষণা ও পর্যালোচনা, যারা মুখে পূর্ণ নিরপেক্ষতার দাবি করত, কিন্তু জানতে ও অজানতে সর্বাবস্থায়ই বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করতে থাকে। অনভিজ্ঞ, সরলপ্রাণ, বেখবর পাঠক আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ শক্তিশূন্য অবস্থায় নিজেকে সজাগ রেখেও তাদের সহজ শিকারে পরিণত হতে থাকে। মন ও মস্তিষ্ক তো ‘ইউরোপীয় পণ্ডিত’ ও পশ্চিমা দার্শনিকদের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং ইলমী ও একাডেমিক ভক্তিতে পুরোপুরি আচ্ছন্নই ছিল। তাদের প্রতিটি বাণী ও বচন যেন অমৃত বচন এবং সর্বপ্রকারে সন্দেহ ও সংশয় থেকে বহু ঊর্ধ্বে। সর্বপ্রকার অগ্রাহ্যতা থেকে পবিত্র। সাংবাদিকতার বিবরণ দিতে গিয়ে আলোচিত হয়েছে যে ১৯১০ এর মার্চ থেকে শেষ বছর পর্যন্ত আননাযের সাময়িকীতে আল্লামা শিবলী রচিত আলকালাম এর নিয়মিত সমালোচনা হতো। মাওলানার কিতাব তো এক আড়াল ছিল মাত্র। নতুবা মূলত সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু ছিল, সমস্ত মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস। আল্লাহ পাকের অস্তিত্ব, রিসালাত, আখেরাত ইত্যাদি। আর এগুলো আমার নাস্তিকতা তো নয়, বরং আমার চূড়ান্ত মূঢ়তা ও সংশয়বাদের ওপর মোহর অঙ্কিত করে দেয়। ১৯১২ সালে হজ্জ সমাপন করা অবস্থায় আব্বাজান ইন্তেকাল করেন। আমার নাস্তিকতা ও বেদীনির কারণে স্বভাবতই তিনি বড় ব্যথিত ও মর্মাহত ছিলেন। যার কাছে আমার সামান্য সংশোধনের সম্ভাবনা দেখতেন তার কাছে আমাকে নিয়ে হাজির হতেন এবং আমার সংশোধনের জন্য ধরনা দিতেন। যে আত্মীয়স্বজনরা হজ্জের সফরে তার সঙ্গে ছিলেন, তাদের কাছ থেকে পরে জানতে পেরেছি যে মরহুম আব্বাজান কাবার গিলাফ ধরে অন্তরের অন্তস্তল থেকে আপন কলিজার টুকরোর হেদায়াত ও সুপথে ফিরে আসার দুআ করেছিলেন। অনন্যোপায় মর্দে মুমিনের তীর দেরিতে হলেও লক্ষ্যবস্তুতে বিদ্ধ না হয়ে পারে? যে মহাক্ষমতাধর সত্যনবী হযরত ইয়াকুবকে কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে তার পুত্রকে ফিরে পাওয়ার দুআ অবশেষে কবুল করেছিলেন, তিনি উম্মতে মুহাম্মদীর এক নগণ্য সদস্য এবং ইয়াকুব পরিবারের এক সামান্য মানুষ আব্দুল কাদের তথা মহাক্ষমতাধরের দাসকে সদা বঞ্চিত রাখতে পারেন?
কলেজে এসে প্রথমে যুক্তিবিদ্যা, তারপর দর্শনের প্রতি গভীর মনোযোগী ছিলাম। যুক্তিবিদ্যা তো কলেজ-কোর্সের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন কোর্সে অন্তর্ভুক্তই ছিল না তখনো অর্থাৎ স্কুল যুগ থেকেই তা লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া শুরু করি। আমি সীতাপুর হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তাম আর ভাইজান তখন লখনৌতে এম.এ-র শিক্ষার্থী। দীর্ঘ ছুটিছাটা কাটাতে যখন সীতাপুর আসতেন, তখন তার কোর্সের বই Stocks Logic নিয়ে পড়া শুরু করতাম। উল্টা-সিধা একরকম বুঝেও নিতাম। যুক্তিবিদ্যার প্রাথমিক গ্রন্থ, প্রাথমিক যুক্তিবিদ্যা এবং উচ্চতর যুক্তিবিদ্যাও অধ্যয়ন করে ফেলি। কলেজে এসে এই নেশা পূরণেরও সুযোগ হয়ে গেল। যুক্তিবিদ্যার কোর্সভুক্ত বই-পুস্তক ছাড়া যুক্তিবিদ্যার অন্যান্য আরও বহু গ্রন্থ কলেজ-লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়তে শুরু করি। এমনকি মিল এর বড় সাইজের সূক্ষ্মগ্রন্থ সিস্টেম অফ লজিকও একপ্রকার চেটেপুটে পড়ে নিলাম। অথচ এটা যতখানি যুক্তিবিদ্যার নয়, তারচেয়ে বেশি দর্শনশাস্ত্রের। এখান থেকে প্রত্যক্ষভাবে দর্শনচর্চা ও দর্শনশাস্ত্রের অধ্যয়নও শুরু হয়ে গেল। বিশেষ করে দর্শনের অন্যতম শাখা সাইকোলজি ও মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা। সাইকোলজির বিভাগ সাইন্সের শাখা হিসেবে ছিল না, দর্শনের শাখা ও বিভাগ হিসেবেই ছিল। আর স্বয়ং এরই কয়েকটা শাখা ও বিভাগ ছিল। ব্যক্তি-মনোবিজ্ঞান ছাড়া সামাজিক মনোবিজ্ঞান, মর্জিমনোবিজ্ঞান-সাইকোলজি ইত্যাদি―নাস্তিক কিংবা প্রায় নাস্তিক দার্শনিকদের ইংরেজি গ্রন্থের অভাব নেই। খুঁজে খুঁজে বাছাই করে করে তাদের গ্রন্থ ভালো করে পড়েছি। মিল এর গ্রন্থ তো পাঠতালিকার শীর্ষে ছিল। তখন সংশয়বাদ ও উপযোগবাদী ধ্যান-ধারণা দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলাম। হুয়ূম ও স্পেনারের রচনাবলি চেটেপুটে পড়ে ফেলেছিলাম।
কিছু এমন লেখকও ছিল যারা মূলত বিজ্ঞানী। তবে নাস্তিক দার্শনিক ছাড়াও শুধু কট্টর নাস্তিকদেরও খুব সমীহ করেছি। যেমন : বৃটেনের চার্লস ব্রেডল, জার্মানীর বুশনার এবং আমেরিকার এঙ্গরসৌল। বলাবাহুল্য, এদের লেখা ও রচনা পড়াশোনার দ্বারা আপন সংশয়বাদ আরও হৃষ্টপুষ্ট হতে থেকেছে এবং নাস্তিকতা আরও জোরালো ও বেগবান হওয়ার পথ পেয়েছে। কিন্তু ঈমান ও ইসলাম থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া এবং সরাসরি কুফর ও ধর্মদ্রোহের অঙ্গনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নাস্তিক এবং প্রায় নাস্তিক লেখকদের রচনা এতটা প্রভাব ও ক্রিয়াশীল প্রমাণিত হয়নি যতটা ওইসব শাস্ত্রীয় রচনাবলি প্রমাণিত হয়েছে, যেগুলো মনোবিজ্ঞান বিষয়ে মনোবিজ্ঞানীদের হাতে রচিত ছিল। বাহ্যত ধর্মের সঙ্গে এগুলোর কোনো যোগসূত্রই ছিল না। নেতিবাচকও না, ইতিবাচকও না। আসল বিষ ওইসব বাহ্যিক নিরামিশ শ্রেণির রচনাবলিতে একেবারে খোলামেলা পাওয়া গেছে। যেমন ড. মাডেসলি (Maudesley) নামে এক ব্যক্তি গত হয়েছে। তার বড়সড় ও মোটা সাইজের দুটি গ্রন্থ সে যুগে বিপুল খ্যাতি লাভ করেছিল―
এক. Mental Physiology(মানসিক শরীরবৃত্ত)
দুই. Mental Pathology(মানসিক রোগবিজ্ঞান)
শেষোক্ত গ্রন্থটিতে মানসিক বৈকল্য ও মানসিক রোগের বিবরণ দিতে দিতে একপর্যায়ে এই নরাধম দৃষ্টান্ত হিসেবে মুহাম্মদী ঐশীবাণীকে নিয়ে এল। এই মহামানবের প্রতি অবিচার করে এই জালেম লিখে ফেলে―মানসিক বৈকল্যের শিকার ব্যক্তির পক্ষে এ বিষয়টি খুবই সম্ভব যে সে জগদ্বাসীর জন্য বিরাট কীর্তি ও অবদান রেখে যাবে! ঈমান ও বিশ্বাসের ভিত্তিমূল পূর্বেই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের নরাধম ‘শাস্ত্রবিদ’দের মুখে এমন অতুলনীয় গবেষণাজাত অমৃতবচন শুনে অবশিষ্ট ঈমানটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল। নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহ ষোলকলায় পূর্ণ হলো।
ঈমান ও ইসলামের তরে প্রাণউৎসর্গকারী প্রিয় ভাই ও বোনেরা! আমার এই দ্ব্যর্থহীন স্বীকারোক্তিগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পাঠ করুন। একটু থামুন। চিন্তা করুন। যে শিক্ষার নরককুণ্ডে আপনারা কলিজার টুকরো সন্তানদের ঠেলে দিচ্ছেন, তা তাদের কোথায় নিয়ে যাবে।
ইন্টারমিডিয়েটের শিক্ষার্থী ছিলাম, ধর্মহীনতাকে ভর করে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলাম, ইতিমধ্যে লন্ডন রেশনালিস্ট পারবাস এসোসিয়েশন (RPA) এর প্রকাশিত মহামূল্যবান গ্রন্থরাজির সূচিপত্র জনৈক ব্যক্তির নিকট দেখতে পেলাম। যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এবং বহু প্রত্যাশিত পরম আরাধ্য বস্তু পেয়ে গেলাম। যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্যানধারণা প্রচারের নামে এসব গ্রন্থ ধর্মদ্রোহ ও নাস্তিকতা বিস্তারেই বেশি ভূমিকা রাখছিল। এগুলোর সরাসরি ও প্রত্যক্ষ আঘাত যদিও খ্রিস্টবাদের ওপরই পড়ত, কিন্তু কোনো ধর্মই তাদের আক্রমণের বাইরে নিরাপদ ও সংরক্ষিত ছিল না। প্রতিটি গ্রন্থ ছয় আনাতেই পাওয়া যেত। সুলভতার সেই যুগে এতটা সুলভতা বড়ই আশ্চর্যজনক ছিল।
প্রথম প্রথম এসব বই ধার নিয়ে নিয়ে পড়তে হয়েছে। পরবর্তীতে যখন ঝোঁক সৃষ্টি হয়ে গেল এবং নেশা আরও তীব্র হলো, তখন ফিস প্রদান করে সংগঠনের নিয়মতান্ত্রিক সদস্য হয়ে গিয়েছি। যখন অনেক বইয়ের একটি সংগ্রহশালা তৈরি হয়ে গেল, তখন গর্বভরে নিজেকে রেশনালিস্ট-যুক্তিবাদী বলে পরিচয় দিতাম। এ নিয়ে খুব গৌরববোধ করতাম এবং এই ছোটখাট গ্রন্থাগারটিতে চোখ বুলিয়ে খুশিতে বাগ বাগ হয়ে যেতাম। ভারতে এই সংগঠনের কোনো শাখা ছিল না। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সংগঠনের অর্ধমাসিক মুখপত্র রেশনালিস্ট রিভিউ কিংবা লিটারেরী গাইড এর কার্যালয়ে পত্রিকার অগ্রিম মূল্য পাঠিয়ে তার গ্রাহক হয়ে গিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে ইসলামের নাম নিতেও লজ্জাবোধ করতে লাগলাম। ইন্টারমিডিয়েটের বার্ষিক পরীক্ষার সময় যখন হলো তখন পরীক্ষা ফরমে ধর্মবিষয়ক খালি ঘরে মুসলিম লেখার পরিবর্তে শুধু ‘রেশনালিস্ট’ লিখেছি।
চিন্তাগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরোপুরি ইউরোপীয় কিংবা বিলেতি হয়ে গেলাম। এ পর্যায়ে স্বভাবতই মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা কমে যেতে থাকল। ইসলামী সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে গমনাগমন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। বড় হিত প্রমাণিত হলো এটিই অর্থাৎ আপন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন বদুস্তুর ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে কায়েম ছিল। আমার সঙ্গীদের একজন ওই সময়ই আপনজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরোপুরি অন্যদের সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছিল। পোশাক-আশাক চলাফেরা সম্পূর্ণ হিন্দুয়ানি করে ফেলেছিল। আমি নিজের খানাপিনা লেবাস-পোশাক এবং সাধারণ সামাজিকতায় বরং বলা ভালো একটা সীমা পর্যন্ত ভাবাবেগের দিক থেকেও মুসলমানই রয়ে যাই। অবশ্য একজন সুশীল ও প্রগতিবাদী নামধারী মুসলমান।
আর তখনকার নওজোয়ানদের প্রগতিবাদী নামধারী মুসলমান কে না চেনে? আর আলহামদুলিল্লাহ মুসলিম সম্প্রদায় থেকে আমার শেকড় তখনো পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। দীনে ইসলামের পরে মুসলিম জাতীয়তার নেয়ামতও এক বিরাট নেয়ামত। কেউ যেন এই নেয়ামতকে বেকার মূল্যহীন মনে না করে। ভবিষ্যতে এ সামান্য নেয়ামতটিই আমার কাছে বড় মূল্যবান মনে হয়েছে। প্যান্ট-শার্ট যা পরেছি তাতে কোনো নতুনত্ব ও অভিনবত্ব ছিল না। এটুকু সকলেই পরত। যাত্রা-থিয়েটারে যতটা গিয়েছি ততটা সকলেই যেত। অবশ্য কখনো মদ পান করিনি, তবে বার বার এটি পরীক্ষা করার স্বাদ মনে জেগেছে। যদি পান করেও নিতাম তবুও তা অবাক হওয়ার মতো কিছু হতো না। মোটকথা এমন কোনো বিষয় ঘটেনি যার দ্বারা সম্পূর্ণ সমাজচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো শ্রেণি আমাকে বয়কটে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেতে পারে।
বড় কথা হলো―কখনো এমন কোনো উক্তি করিনি যার দ্বারা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে। যা-ই বলেছি ইলমী ও একাডেমিক পরিধির ভেতরে থেকে মূল বিষয় নিয়ে বলেছি। সমালোচনা যখন করেছি তখনো আকীদাগত বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেছি। কোনো ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বকে কখনো সমালোচনার পাত্র বানাইনি। ভাবাবেগের দিক থেকে অনেকটা মুসলমান রয়ে যাওয়ার ধারাক্রমে এ মজার বিষয়টিও শোনার মতো যে কোনো অমুসলিম যখন ইসলাম সম্পর্কে কোনো আপত্তি করত, তখন তার পক্ষ নিতে এবং সহায়তা করতে হৃদয় সাড়া দিত না। বরং পূর্ণ নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহের কবলে থাকা সত্ত্বেও অন্তর প্রতিউত্তর দিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসত।
অক্টোবর ১৯১১ এর ঘটনা। খ্রিস্টানদের একটি বড় কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য চরম ইসলামবিদ্বেষীখ্যাত পাদরি যোয়মের (Zuemer)ও বাহরাইন থেকে এসে উপস্থিত হলো। তার ইসলামবিদ্বেষের খ্যাতি তার আগমনের পূর্বেই এ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি বি.এ-র শিক্ষার্থী ছিলাম। বিশ্বাস ও আদর্শগতভাবে পুরোপুরি ইসলামবিরোধী। আপন এক বন্ধু মাওলানা আব্দুল বারী নদভীকে সঙ্গে করে চট করে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। সাক্ষাতে পাদরি সাহেব খুব ভদ্র ও বিনীত আচরণ করলেন। কিন্তু অভ্যাসবশত কথাবার্তায় ইসলামের ওপর আক্রমণ করতে থাকলেন। প্রিয় পাঠক, বিশ্বাস করুন, নদভী সাহেব যে-ই পাদরিকে আরবীতে প্রতিউত্তর দিতে লাগলেন তদ্রূপ আমিও ইংরেজিতে তার জবাব দিতে শুরু করলাম। পাদরি সাহেব কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না যে আমি তো নিজেই ইসলামত্যাগী মুরতাদ (তবুও কেন ইসলামের পক্ষ নিয়ে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি।) কোনো পাদরি কিংবা আর্যসমাজী অথবা কোনো প্রকাশ্য ইসলামবিরোধীর কোনো প্রভাব একেবারেই আমার উপর ছিল না। যতটা প্রভাবিত হয়েছিলাম তার সবই ছিল ইসলামের গোপন শত্রুদের দ্বারা। তাদের জ্ঞান-গরিমা ও পাণ্ডিত্য, তাদের উন্নত গবেষণা ও পর্যালোচনা, যারা মুখে পূর্ণ নিরপেক্ষতার দাবি করত, কিন্তু জানতে ও অজানতে সর্বাবস্থায়ই বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করতে থাকে। অনভিজ্ঞ, সরলপ্রাণ, বেখবর পাঠক আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ শক্তিশূন্য অবস্থায় নিজেকে সজাগ রেখেও তাদের সহজ শিকারে পরিণত হতে থাকে। মন ও মস্তিষ্ক তো ‘ইউরোপীয় পণ্ডিত’ ও পশ্চিমা দার্শনিকদের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং ইলমী ও একাডেমিক ভক্তিতে পুরোপুরি আচ্ছন্নই ছিল। তাদের প্রতিটি বাণী ও বচন যেন অমৃত বচন এবং সর্বপ্রকারে সন্দেহ ও সংশয় থেকে বহু ঊর্ধ্বে। সর্বপ্রকার অগ্রাহ্যতা থেকে পবিত্র। সাংবাদিকতার বিবরণ দিতে গিয়ে আলোচিত হয়েছে যে ১৯১০ এর মার্চ থেকে শেষ বছর পর্যন্ত আননাযের সাময়িকীতে আল্লামা শিবলী রচিত আলকালাম এর নিয়মিত সমালোচনা হতো। মাওলানার কিতাব তো এক আড়াল ছিল মাত্র। নতুবা মূলত সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু ছিল, সমস্ত মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস। আল্লাহ পাকের অস্তিত্ব, রিসালাত, আখেরাত ইত্যাদি। আর এগুলো আমার নাস্তিকতা তো নয়, বরং আমার চূড়ান্ত মূঢ়তা ও সংশয়বাদের ওপর মোহর অঙ্কিত করে দেয়। ১৯১২ সালে হজ্জ সমাপন করা অবস্থায় আব্বাজান ইন্তেকাল করেন। আমার নাস্তিকতা ও বেদীনির কারণে স্বভাবতই তিনি বড় ব্যথিত ও মর্মাহত ছিলেন। যার কাছে আমার সামান্য সংশোধনের সম্ভাবনা দেখতেন তার কাছে আমাকে নিয়ে হাজির হতেন এবং আমার সংশোধনের জন্য ধরনা দিতেন। যে আত্মীয়স্বজনরা হজ্জের সফরে তার সঙ্গে ছিলেন, তাদের কাছ থেকে পরে জানতে পেরেছি যে মরহুম আব্বাজান কাবার গিলাফ ধরে অন্তরের অন্তস্তল থেকে আপন কলিজার টুকরোর হেদায়াত ও সুপথে ফিরে আসার দুআ করেছিলেন। অনন্যোপায় মর্দে মুমিনের তীর দেরিতে হলেও লক্ষ্যবস্তুতে বিদ্ধ না হয়ে পারে? যে মহাক্ষমতাধর সত্যনবী হযরত ইয়াকুবকে কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে তার পুত্রকে ফিরে পাওয়ার দুআ অবশেষে কবুল করেছিলেন, তিনি উম্মতে মুহাম্মদীর এক নগণ্য সদস্য এবং ইয়াকুব পরিবারের এক সামান্য মানুষ আব্দুল কাদের তথা মহাক্ষমতাধরের দাসকে সদা বঞ্চিত রাখতে পারেন?
টানাপোড়েন
নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহের এ সময়কাল বলতে গেলে দশ বছর স্থায়ী হয়। ১৯০৯ সালে কিংবা তার কিছুকাল আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এবং ১৯১৮ এর শেষ তিন মাস পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বর্তমানে দশ বছর সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর এবং তারপরও এত দিন বিগত হওয়া সত্ত্বেও একে বেশি বড় ও দীর্ঘ মনে হয় না। কিন্তু কল্পনার চোখের সামনে নাস্তিকতার যুগটি একটু মেলে ধরুন, যখন তা ‘অতীত’ ছিল না ‘বর্তমান’ ছিল, অব্যাহতভাবে চলছিল এবং বড় জোরে শোরে চলছিল―আল্লাহ মাফ করুন―কত দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। মনে হতো না যে জীবনের এ অধ্যায়ের কখনো পরিসমাপ্তি ঘটবে। নিজের কাছেও এমনই মনে হতো এবং পরিচিতজনদের কাছেও। দোস্ত-দুশমন, স্বপক্ষ-প্রতিপক্ষ সকলের কাছেই (হাতে গোনা দু-চারজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছাড়া, যারা এ অবস্থার সাময়িক হওয়াটা আঁচ করে ফেলেছিলেন)। সময়টা ছিল ১৯১৮ এর আগস্ট মাস। আমি হায়দারাবাদ থেকে লখনৌ ফিরে এলাম। আপন পুরোনো নেশা ও আসক্তির সুবাদে ধর্মপ্রাণ কিংবা প্রায় ধর্মপ্রাণ শ্রেণির দার্শনিকদের রচিত গ্রন্থরাজি অধ্যয়ন শুরু করলাম। ইউরোপের শোপেন হায়েরদের মতো লেখকদের রচনার দ্রুত পাঠ চুকিয়ে প্রথম নম্বরে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াশের পালা এল। এই দার্শনিকের শিক্ষা ও দর্শন আর যা-ই হোক, শোপেন হায়েরের মতো নিরেট বস্তুতান্ত্রিক ছিল না। নৈতিক ও চারিত্রিক উপাদান তাতে এতদূর বিস্তৃত ছিল যে তার আলোচনার সূত্রগুলো সবশেষে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে গিয়ে যুক্ত হতো। অদৃশ্য জগতের সঙ্গে তার অল্পবিস্তর যোগাযোগও ছিল। বলা ভালো, এটাই কোনো দার্শনিকের রচিত প্রথম গ্রন্থ ছিল, যা নিরেট বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখার পরিবর্তে অনেকটা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছিল। অনুসন্ধানী মানসিকতা কদমকে আরও অগ্রসর করল। আর এই ধাপে কলেজের পুরোনো সহপাঠী ডক্টর মুহাম্মদ হাফীজ সায়্যিদ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। ধীরে ধীরে বুদ্ধ-মতবাদ চীনা ধর্মমত এবং যিয়সুফী মতবাদের সন্ধান পেলাম। সর্বময় প্রজ্ঞার আধার মহান সত্তার পক্ষ থেকে হেদায়াত ও দীক্ষার যথার্থ উপকরণের ব্যবস্থা প্রত্যেক ধাপে ধাপে এমনকি প্রত্যেক কদমে কদমে হতে থাকল!
বুদ্ধ-মতবাদের সূক্ষ্ম ও একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ পড়লাম, আর এতে বুঝতে পারলাম―বুদ্ধ-মতবাদ নিছক কিছু অলীক কল্পনার সমষ্টির নাম নয়, বরং এতে আত্মা ও মানবাত্মা সম্পর্কে গভীর কিছু তত্ত্ব ও রহস্য এবং হাকীকত ও তাৎপর্য রয়েছে। এরপর যিয়সুফী মতবাদের পালা শুরু হলো (আর বলাবাহুল্য এসব পড়াশোনাই চলছিল ইংরেজি ভাষার সহায়তায়) যিয়সুফীকে হিন্দু সন্ন্যাসবাদ কিংবা হিন্দু সন্ন্যাসবাদী দর্শন মনে করতে পারেন। এতে আত্মা এবং আত্মার বিকাশ ও উৎকর্ষের প্রতি সর্বাধিক জোর দেওয়া হয়েছে। এর ধরন কিছুটা জিন উপস্থিত করার তদবীরের সঙ্গে মেলে।
মিসেস এনি বিসেন্ট (যিনি খ্রিস্টধর্ম ছেড়ে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছিলেন) এই মতবাদের প্রাণ ও প্রেরণা ছিলেন এবং এর জোরদার প্রচারক ও আহ্বায়ক ছিলেন। আর বেনারসের দার্শনিক সাধু ডক্টর ভগবান দাস (যিনি এই কিছুকাল হলো নব্বই বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।) হিন্দু সন্ন্যাসবাদ ও হিন্দু-দর্শনের শ্রেষ্ঠ মুখপাত্র ও ব্যাখ্যাকার ছিলেন। এ দুজনের লেখা ও রচনার অনেকটাই পড়েছি আর তা থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আর মহারাষ্ট্রের লোকমান্য তিলক এবং অবিভক্ত বাংলা ও দক্ষিণ ভারতের আরবিন্দ ঘোষের সমস্ত রচনা পড়ে শেষ করে ফেলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এই সময়েই শ্রীকৃষ্ণের ভগবতগীতার যত নুসখা ও এডিশন হাতের কাছে পাওয়া যায় সব সংগ্রহ করে পড়ে ফেললাম। এই গ্রন্থ যেন চোখের সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। আর আধ্যাত্মিক জগৎ তথা বস্তুজগতের বাইরের আরেকটি জগৎ দৃষ্টিগোচর হতে লাগল। ওই সময়ে মহাত্মা গান্ধীর লেখা বিভিন্ন রচনা অধ্যয়নে আসতে থাকে। মহাজগতের ছোট-বড় প্রতিটি বস্তুতান্ত্রিক ঘটনা ও দুর্ঘটনার কোনো না-কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা তার বহু রচনায় বারবার দেখার সুযোগ হতে থাকে। দেড়-দুই বছরের (১৯১৯-১৯২০) লাগাতার অধ্যয়নের সারনির্যাস এই দাঁড়াল যে হৃদয়ে আসন গেড়ে থাকা ইউরোপীয় বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিমা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হতে লাগল যে মহাজাগতিক রহস্য ও গুপ্তভেদ সম্পর্কে চূড়ান্ত ও সর্বশেষ ব্যাখ্যা ইউরোপীয় বস্তুবাদীদের ব্যাখ্যা নয়; বরং পৃথিবীতে এর চেয়ে উন্নত ও সন্তোষজনক আরও ব্যাখ্যা রয়েছে। আধ্যাত্মিকতার কূলকিনারাহীন জগৎ নিছক ধারণা ও অজ্ঞতাপ্রসূত নয়। নয় তাচ্ছল্য ও উপহাসজনক; বরং চিরসত্য ও বাস্তব জগৎ এবং শ্রদ্ধা ও সমীহযোগ্য। তাহকীক, গবেষণা ও সূক্ষ্মতার দিক থেকে গৌতম বুদ্ধ এবং শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা-দীক্ষা কোনো অংশেই মিল ও স্পেন্সার থেকে কম তো নয়ই, বরং অনেকাংশে উন্নত ও সমৃদ্ধ। এদের সামনে ইউরোপীয় দার্শনিকদের অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও অগভীর দৃষ্টির অধিকারী মনে হতে লাগল। এদের নীতি-শিক্ষা-দীক্ষাও ইসলাম থেকে যথেষ্ট দূরে ছিল। তবে যা-ই হোক, এখন জীবনতত্ত্ব ও আ-রহস্য মহাজাগতিক তত্ত্ব ও গুপ্ততত্ত্বের ব্যাপারে দৃষ্টির সম্মুখে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে গেল। বস্তুবাদ, অজ্ঞতাবাদ ও সংশয়বাদের যে গগনচুম্বী সৌধ বছরের পর বছর ধরে নির্মিত হয়েছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। অন্তকরণে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেল যে বস্তুবাদের বাইরে এবং তার চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে আরেকটি জগৎ আছে, তা হলো―আধ্যাত্মিক জগৎ । পঞ্চইন্দ্রিয়ের দেখা-শোনা ও ধরা-ছোঁয়াই সবকিছু নয়। এসবের অতল তলে এসবের বহু ঊর্ধ্বে গায়েব-অদৃশ্য ও দৃষ্টিশক্তির ধরা-ছোঁয়ার বাইরে একটি স্বতন্ত্র জগতের অস্তিত্ব বিদ্যমান। মহাগ্রন্থ আল কোরআন একেবারে সূচনাতে যে ঈমানের কথা বর্ণনা করেছে, তা-তে ‘ঈমান বিল গায়ব’ বা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপনের গুণের কথা বলেছে, তা অত্যন্ত সারগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমে স্বয়ং গায়েব এর প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস তো থাকতে হবে। তারপর তার শাখা-প্রশাখা ও বিশদ বিবরণ অবগতি লাভ হতে থাকবে।
আমাদের মাওলানা সাহেবরা হয়তো আমার এই ধাপ ও পর্যায়কে অবমূল্যায়ন করতে পারেন। কিন্তু বস্তুত এটাই ছিল সংশয়বাদ ও নাস্তিকতার লশকরের বিরুদ্ধে ঈমান-আকীদা ও আধ্যাত্মিকতার বিরাট ও প্রকাশ্য বিজয়।
এই পর্ব ও অধ্যায়ের সবেমাত্র সূচনা, ইতিমধ্যে আল্লামা শিবলীর সীরাতুন্নবীর প্রথম খ- প্রেস থেকে ছেপে পাঠকদের হাতে চলে এসেছে। গ্রন্থটি ছিল শিবলীর মতো মনীষীর কলমে রচিত; সুতরাং বিষয়বস্তু যা-ই হোক, তা কি আর পরম আগ্রহে না পড়ে থাকা যায়। তাই পরম আগ্রহে গ্রন্থটি হাতে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। আদ্যোপান্ত পড়ে শেষ করা পর্যন্ত দম ফেললাম না। মনের আসল চোর তো এখানেই ছিল। দুর্ভাগা প্রবৃত্তি সবচেয়ে বড় যে হোঁচট খেয়েছিল, তা তো এই পবিত্র সীরাতের ব্যাপার নিয়েই ছিল। প্রাচ্যবিদ ও ইউরোপীয় গবেষকদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু তো প্রিয়তম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সত্তাই ছিল। বিশেষত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুদ্ধ-বিগ্রহসমূহের ব্যাপারে মতলববাজ লেখকরা তো বিভিন্নভাবে মন-মস্তিষ্কে এ কথা বদ্ধমূল করে দিয়েছিল যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক একজন জালেম বিজেতার চেয়ে আলাদা কিছু ছিলেন না (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লামা শিবলী তার গ্রন্থে এই ব্যথারই অব্যর্থ প্রতিষেধক দিয়েছেন। ওই যখমের ওপরই মলমের শীতল প্রলেপ দিয়েছেন। আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতের টুকরোয় পরিণত করে দিন।
বই যখন বন্ধ করলাম, তখন কল্পনার চোখে রাসূলে আরাবীর যে চিত্র ভেসে উঠল, তা ছিল দেশ ও জাতির এক মহান সংস্কারক এবং এক উদার ও দয়ালু শাসকের চিত্র, যাকে যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়াতে হয়েছে তো একেবারে শেষ পর্যায়ে জড়াতে হয়েছে। একেবারে অনন্যোপায় হয়ে। এই মর্যাদা নিঃসন্দেহে আজ প্রত্যেক মুসলমানের কাছে অনেক কম ও নিচে মনে হবে এবং এ ক্ষেত্রে লেখক শিবলীর কোনো মূল্য ও অবদান নজরে পড়বে না। কিন্তু এর মূল্য একটু ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, যার অন্তর―নাউযুবিল্লাহ―প্রিয়নবীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। শিবলীর এই গ্রন্থের অনুগ্রহ আমি কখনো ভুলতে পারব না। বিশ্বাসীদের কাছে আবু তালিবের মর্যাদা যতটাই থাকুক আর যে পরিমাণই হোক, আবু লাহাব ও আবু জাহেলের শত্রুতার সঙ্গে তার কোনো তুলনাই চলতে পারে না।
এই পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কেবল বইপুস্তকের আলোচনাই হয়েছে, এখন কিছুক্ষণের জন্য মূল আলোচনা থেকে সরে গিয়ে ওই সকল ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের নাম শুনে নেওয়া যাক, যারা এই ক্রান্তিকালে আমার ও ইসলামের মধ্যে দূরত্ব ঘুচাতে সহায় হয়েছেন। স্বভাবতই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে যে আমার সম্পর্ক যখন মুসলমান আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যথারীতি বহাল ছিল, তাহলে এদের অধিকাংশই আমার এ দুর্যোগে কেন নীরব রইল, তারা প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে কেন তাবলীগের গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিল না? উত্তরে প্রথমত অনেকটা মুসলিম সমাজের ব্যাপক গাফলত ও উদাসীনতা, নির্জীবতা ও স্থবিরতা, অনুভূতিশূন্যতা ও মনরক্ষার একধরনের ভুল রীতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত আপন সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী অনেকে হাত-পা মেরেছে, কিন্তু আমার নিকট তা গ্রাহ্যই হয়নি। তাই আমার উপর কারও চেষ্টা ও তদবীরের প্রভাব পড়বে কোত্থেকে। লখনৌর ফিরিঙ্গি মহলের এক বিখ্যাত মাওলানা সাহেব, ইউপির এক বিখ্যাত পীর সাহেব, দিল্লীর এক প্রসিদ্ধ বুযুর্গ―এরা সকলেই আমাকে ধরতে আপন আপন শিকার-জাল ফেলেছেন, কিন্তু আমি কারও কাছেই ধরা দিইনি।
ہرچہ كردند ازعلاج وازدوا
ربح افزوں گشت وحاجت ناروا
রোগ নিরাময়ে যতই দাওয়াইর প্রয়োগ চলতে লাগল ততই রোগ বাড়তে থাকল এবং নানা বিপত্তি দেখা দিতে থাকল।
তবে হ্যাঁ, কারও আন্তরিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ চেষ্টা তদবীর যদি চুপে চুপে কাজে করে, তাহলে শুধু এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে : এক. এলাহাবাদের বিখ্যাত রসিক কবি জনাব আকবর এলাহাবাদী রহ.―তিনি কখনো তর্ক-বিতর্কের ছায়াও মাড়াননি। আর না কখনো নসীহত ও উপদেশের ঝুলি খুলেছেন। শুধু সময়ে সুযোগে চুপে চুপে আপন মধুর ভঙ্গিতে এমন দু-চারটি কথা বলতেন, যা হৃদয়ে গেঁথে যেত। আর মন-মস্তিষ্কে যে ঝাঁকুনি দিত, তাতে আর যা-ই হোক, হক ও সত্য কবুল করে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হতে থাকত। একদিন বললেন―‘জনাব, আপনি তো কলেজে বিষয় হিসেবে আরবী ভাষাকেও গ্রহণ করেছিলেন। এখন কি তার সঙ্গে সম্পর্ক বহাল আছে? বিদ্যা ও ভাষা যেটাই হোক তার তো মূল্যায়ন করা উচিত।’
আমি বললাম―‘এখন আর তা চর্চা করার সময় কোথায়?’
তিনি বললেন―‘তা এমন কঠিন কিছু তো নয়। কোরআন শরীফের অনুপম সাহিত্যকে তো ইউরোপীয়রাও স্বীকার করে। আমি শুনেছি জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরবী সাহিত্যের কোর্সে কোরআন শরীফের শেষ পনেরো পারাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আপনি আকীদা-বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে না হোক, অন্তত আরবী সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে কোরআন শরীফের সঙ্গে বন্ধন অটুট রাখুন। দৈনিক যে কয় মিনিট সময় বের করতে পারেন, তাতেই কিছুটা পড়ে নেবেন। যে যে জায়গা বুঝে না আসবে তা ছেড়ে দেবেন, আর এ কথা ধরে নেবেন যে ওই অংশগুলো আপনার জন্য নয়। এভাবে পাঠ অব্যাহত রাখলে দু-একটি বাক্য আপনার ভালো লেগেই যাবে; ব্যস, ওই বাক্যগুলো দু-চার বার পড়ে নেবেন। আর আপনার জন্য ওযু করে পড়ার শর্তও রক্ষা করতে হবে না।’
এ হলো তার তাবলীগের একটি নমুনা।
দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব হলেন―বিখ্যাত দেশবরেণ্য নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার রহ.। বড় জোরদার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। আর আমার তো একপ্রকার প্রিয়তম ব্যক্তিই ছিলেন। কখনো চিঠিতে, কখনো মুখে যখনই সামান্য সুযোগ পেতেন, বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কখনো হেসে, কখনো গর্জন করতে করতে, কখনো চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তাবলীগের কাজে সেরে ফেলতেন। তাঁর উন্নত মস্তিষ্ক, প্রখর ধীশক্তি, শাণিত বুদ্ধি, গভীর জ্ঞান এবং নিখাদ ইখলাস ও আন্তরিকতা পূর্ব থেকেই আমার নিকট স্বীকৃত ছিল। তাই এই দুই মনীষীর তাবলীগ কখনো ভারী ও কষ্টকর মনে হয়নি। তাঁরা নসিহত ও কল্যাণকামিতার হক পুরোপুরি আদায় করে পুণ্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছিলেন। এই দুই মহান গুরুভার ব্যক্তিত্বের পর তৃতীয় আরেকটি নাম শুনে নিন। তিনি হলেন আমার প্রিয় সঙ্গী মাওলানা আব্দুল বারী নদভী। আর সেই তিনি আজ (১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে) মাওলানা শাহ আব্দুল বারী, খলীফায়ে থানভী হিসেবে সারা দেশে সমধিক পরিচিত। ধীরে ধীরে তাঁর ভালোই প্রভাব পড়ছিল। চতুর্থ জন হিসেবে একজন অমুসলিম ব্যক্তিত্বের নাম না নিলেই নয়। তিনি হলেন বেনারসের বিদগ্ধ দার্শনিক সন্ন্যাস বাবু ভগবান দাস। বস্তুবাদের অতল গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে এবং আধ্যাত্মিকতার আলোকরৌশনিতে পৌঁছতে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। তার লেখা ও রচনা দ্বারা উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি প্রায়শই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ ঘটত।
গীতা অধ্যয়নের সুবাদে মন-মানসিকতায় সূফীবাদের প্রতি একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। অলি-বুযুর্গদের কারামত ও অলৌকিক ঘটনার ব্যাপারে এখন আর বিরূপ মনোভাব ছিল না; বরং এসবের প্রতি একটা ঝোঁক ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। আর এ সম্পর্কে উর্দু-ফার্সীতে অনেক বই-পুস্তকও পড়া হয়ে গিয়েছিল।
অন্তর্জগৎ ও মনোজগতে গভীর প্রভাব বিস্তারকারী উল্লেখযোগ্য মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হলেন, দেওয়া অঞ্চলের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হাজী ওয়ারেছ আলী শাহ। তার বাণীসঙ্কলন বড় মুগ্ধ নয়নে পড়তাম। স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ধারণা নিয়ে সচেতনভাবে মুসলমান হওয়ার আগেই তাঁর কারামত ও অলৌকিক ঘটনাবলি আগ্রহভরে শুনতে লাগলাম। ১৯১৯ সনের শেষের দিকের কথা। লখনৌর বাসিন্দা এক নিকটাত্মীয় সৈয়দ মমতাজ আহমদের নিকট কানপুরের ঝকঝকে ছাপা, সুন্দর বাঁধাইয়ের মাওলানা রুমীর অমর কাব্যগ্রন্থ মসনবী শরীফের পুরো ছয় দফতর দেখতে পেলাম। পাঠের পুরোনো অভ্যাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বেচারা বড় খুশি খুশি এক এক দফতর দিতে শুরু করল। গ্রন্থখানা অধ্যয়ন শুরু করতে দেরি ছিল, কিন্তু এ কথা মনে হতে দেরি হলো না যে কে যেন আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছে। গ্রন্থখানা আমি রেখে উঠতে চাইলেও গ্রন্থখানা আমাকে ছাড়ে না। তখন ফার্সীভাষায় যোগ্যতাই বা কতখানি ছিল। হাজারো কবিতার আগা-মাথার কিছুই বুঝে আসত না কিন্তু তবুও তার আকর্ষণ ও সম্মোহন এতই প্রবল ছিল যে একপ্রকার আত্মহারা হয়ে পড়ে চলেছি এবং গ্রন্থখানা থেকে চোখ আলগ করতে পারছি না। এই অস্পষ্ট ও ভাসাভাসা বুঝেই সম্পূর্ণ আত্মহারা হয়ে একপ্রকার মত্ততা অনুভব করতে লাগলাম। কোথায় নাওয়া-খাওয়া আর কোথায়-নিদ্রা বিশ্রাম। মনেপ্রাণে শুধু একই কামনা―রুদ্ধদ্বারে নির্জনে অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে পারা। পড়তে পড়তে কখনো চোখের পানিতে ভেসে যাওয়া, আর কখনো অজান্তেই চিৎকার করে ওঠা। গ্রন্থখানার টীকা ছিল আরও মারাত্মক। উপরন্তু তা ছিল ‘মুরশিদুনা কেবলায়ে আলম’ এর কলমে লেখা। দেখতে সংক্ষিপ্ত, কয়েক শব্দের। কিন্তু ছিল পুরো পঙ্ক্তির সারনির্যাস। (পরে জানতে পারি ‘মুর্শিদুনা’ হলেন যুগশ্রেষ্ঠ অলি, মহান বুযুর্গ হাজী এমদাদুল্লাহ মুহজিরে মক্কী রহ.) মনে নেই গ্রন্থখানা কত দিনে খতম হয়েছে। যখনই শেষ হয়ে থাক, তবে এতটুকু মনে পড়ে―অন্তর মমতাজ মিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতায় টইটুম্বুর ছিল। কারণ, এই অমূল্য রত্ন তার মাধ্যমেই প্রাপ্ত হয়েছিলাম। কোনো প্রকার তর্ক-বিতর্ক ছাড়াই সংশয়-সন্দেহের ছিটেফোঁটা আর অন্তরে বাকি রইল না। অন্তরাত্মা তখন মসনবী রচয়িতার প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাস স্থাপনে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। যেন খোদা এবং রাসূল সবই তিনি (নাউযুবিল্লাহ)। প্রকৃত অর্থে যদিও তখনো মুসলমান হয়নি কিন্তু কুফর ও কুফুরী মতবাদ থেকে অন্তর পুরোপুরি সরে গিয়েছিল। সংশয়বাদ ও ইউরোপীয় নাস্তিকতাকে শতমুখে অভিশাপ দিচ্ছিল।
ধারাবাহিক পরিবর্তনের এই ধাপ ও পর্যায়ে এসে তাসাউফের অনেক ফার্সী বই-পুস্তক পড়ে ফেললাম। ফরীদুদ্দীন আত্তারের মানতিকুত তাইর, জামীর নফহাতুল উনস ইত্যাদি। অদ্ভুত ও অলৌকিক ঘটনাবলি হৃদয়কে নাড়া দিত। অন্তরাত্মাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। কাশফ ও কারামতের ঘটনাবলি গভীর আগ্রহ এবং পরম ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে শ্রবণ করতাম। লখনৌর ওই বাড়িতে নাঈমুযযামান নামে আমার এক খালাত ভাই এসে অবস্থান করত। ও নিজেই একটা সূফীবিশ্বকোষ ছিল, তার সান্নিধ্য সোনায় সোহাগার কাজ দিল। সময় সময় মাজারে যাওয়া, ওরস ও কাওয়ালিতে অংশগ্রহণ করা শুরু হয়ে গেল। লখনৌতেও লখনৌর বাইরে দেওয়া অঞ্চলে হাজী ওয়ারিস আলী শাহকে তো কিছুকাল পর্যন্ত সর্বত্র হাযির-নাযির মনে করতাম (নাউযুবিল্লাহ)! ইসলাম থেকে দূরত্ব এখন দিন দিন কমতে থাকল এবং প্রতি পদক্ষেপ তারই পানে ধাবিত হচ্ছিল। হোক তা কবরপূজা ও পীরপূজার হাত ধরে।
নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহের এ সময়কাল বলতে গেলে দশ বছর স্থায়ী হয়। ১৯০৯ সালে কিংবা তার কিছুকাল আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এবং ১৯১৮ এর শেষ তিন মাস পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বর্তমানে দশ বছর সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর এবং তারপরও এত দিন বিগত হওয়া সত্ত্বেও একে বেশি বড় ও দীর্ঘ মনে হয় না। কিন্তু কল্পনার চোখের সামনে নাস্তিকতার যুগটি একটু মেলে ধরুন, যখন তা ‘অতীত’ ছিল না ‘বর্তমান’ ছিল, অব্যাহতভাবে চলছিল এবং বড় জোরে শোরে চলছিল―আল্লাহ মাফ করুন―কত দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। মনে হতো না যে জীবনের এ অধ্যায়ের কখনো পরিসমাপ্তি ঘটবে। নিজের কাছেও এমনই মনে হতো এবং পরিচিতজনদের কাছেও। দোস্ত-দুশমন, স্বপক্ষ-প্রতিপক্ষ সকলের কাছেই (হাতে গোনা দু-চারজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছাড়া, যারা এ অবস্থার সাময়িক হওয়াটা আঁচ করে ফেলেছিলেন)। সময়টা ছিল ১৯১৮ এর আগস্ট মাস। আমি হায়দারাবাদ থেকে লখনৌ ফিরে এলাম। আপন পুরোনো নেশা ও আসক্তির সুবাদে ধর্মপ্রাণ কিংবা প্রায় ধর্মপ্রাণ শ্রেণির দার্শনিকদের রচিত গ্রন্থরাজি অধ্যয়ন শুরু করলাম। ইউরোপের শোপেন হায়েরদের মতো লেখকদের রচনার দ্রুত পাঠ চুকিয়ে প্রথম নম্বরে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াশের পালা এল। এই দার্শনিকের শিক্ষা ও দর্শন আর যা-ই হোক, শোপেন হায়েরের মতো নিরেট বস্তুতান্ত্রিক ছিল না। নৈতিক ও চারিত্রিক উপাদান তাতে এতদূর বিস্তৃত ছিল যে তার আলোচনার সূত্রগুলো সবশেষে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে গিয়ে যুক্ত হতো। অদৃশ্য জগতের সঙ্গে তার অল্পবিস্তর যোগাযোগও ছিল। বলা ভালো, এটাই কোনো দার্শনিকের রচিত প্রথম গ্রন্থ ছিল, যা নিরেট বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখার পরিবর্তে অনেকটা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছিল। অনুসন্ধানী মানসিকতা কদমকে আরও অগ্রসর করল। আর এই ধাপে কলেজের পুরোনো সহপাঠী ডক্টর মুহাম্মদ হাফীজ সায়্যিদ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। ধীরে ধীরে বুদ্ধ-মতবাদ চীনা ধর্মমত এবং যিয়সুফী মতবাদের সন্ধান পেলাম। সর্বময় প্রজ্ঞার আধার মহান সত্তার পক্ষ থেকে হেদায়াত ও দীক্ষার যথার্থ উপকরণের ব্যবস্থা প্রত্যেক ধাপে ধাপে এমনকি প্রত্যেক কদমে কদমে হতে থাকল!
বুদ্ধ-মতবাদের সূক্ষ্ম ও একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ পড়লাম, আর এতে বুঝতে পারলাম―বুদ্ধ-মতবাদ নিছক কিছু অলীক কল্পনার সমষ্টির নাম নয়, বরং এতে আত্মা ও মানবাত্মা সম্পর্কে গভীর কিছু তত্ত্ব ও রহস্য এবং হাকীকত ও তাৎপর্য রয়েছে। এরপর যিয়সুফী মতবাদের পালা শুরু হলো (আর বলাবাহুল্য এসব পড়াশোনাই চলছিল ইংরেজি ভাষার সহায়তায়) যিয়সুফীকে হিন্দু সন্ন্যাসবাদ কিংবা হিন্দু সন্ন্যাসবাদী দর্শন মনে করতে পারেন। এতে আত্মা এবং আত্মার বিকাশ ও উৎকর্ষের প্রতি সর্বাধিক জোর দেওয়া হয়েছে। এর ধরন কিছুটা জিন উপস্থিত করার তদবীরের সঙ্গে মেলে।
মিসেস এনি বিসেন্ট (যিনি খ্রিস্টধর্ম ছেড়ে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছিলেন) এই মতবাদের প্রাণ ও প্রেরণা ছিলেন এবং এর জোরদার প্রচারক ও আহ্বায়ক ছিলেন। আর বেনারসের দার্শনিক সাধু ডক্টর ভগবান দাস (যিনি এই কিছুকাল হলো নব্বই বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।) হিন্দু সন্ন্যাসবাদ ও হিন্দু-দর্শনের শ্রেষ্ঠ মুখপাত্র ও ব্যাখ্যাকার ছিলেন। এ দুজনের লেখা ও রচনার অনেকটাই পড়েছি আর তা থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আর মহারাষ্ট্রের লোকমান্য তিলক এবং অবিভক্ত বাংলা ও দক্ষিণ ভারতের আরবিন্দ ঘোষের সমস্ত রচনা পড়ে শেষ করে ফেলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এই সময়েই শ্রীকৃষ্ণের ভগবতগীতার যত নুসখা ও এডিশন হাতের কাছে পাওয়া যায় সব সংগ্রহ করে পড়ে ফেললাম। এই গ্রন্থ যেন চোখের সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। আর আধ্যাত্মিক জগৎ তথা বস্তুজগতের বাইরের আরেকটি জগৎ দৃষ্টিগোচর হতে লাগল। ওই সময়ে মহাত্মা গান্ধীর লেখা বিভিন্ন রচনা অধ্যয়নে আসতে থাকে। মহাজগতের ছোট-বড় প্রতিটি বস্তুতান্ত্রিক ঘটনা ও দুর্ঘটনার কোনো না-কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা তার বহু রচনায় বারবার দেখার সুযোগ হতে থাকে। দেড়-দুই বছরের (১৯১৯-১৯২০) লাগাতার অধ্যয়নের সারনির্যাস এই দাঁড়াল যে হৃদয়ে আসন গেড়ে থাকা ইউরোপীয় বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিমা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হতে লাগল যে মহাজাগতিক রহস্য ও গুপ্তভেদ সম্পর্কে চূড়ান্ত ও সর্বশেষ ব্যাখ্যা ইউরোপীয় বস্তুবাদীদের ব্যাখ্যা নয়; বরং পৃথিবীতে এর চেয়ে উন্নত ও সন্তোষজনক আরও ব্যাখ্যা রয়েছে। আধ্যাত্মিকতার কূলকিনারাহীন জগৎ নিছক ধারণা ও অজ্ঞতাপ্রসূত নয়। নয় তাচ্ছল্য ও উপহাসজনক; বরং চিরসত্য ও বাস্তব জগৎ এবং শ্রদ্ধা ও সমীহযোগ্য। তাহকীক, গবেষণা ও সূক্ষ্মতার দিক থেকে গৌতম বুদ্ধ এবং শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা-দীক্ষা কোনো অংশেই মিল ও স্পেন্সার থেকে কম তো নয়ই, বরং অনেকাংশে উন্নত ও সমৃদ্ধ। এদের সামনে ইউরোপীয় দার্শনিকদের অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও অগভীর দৃষ্টির অধিকারী মনে হতে লাগল। এদের নীতি-শিক্ষা-দীক্ষাও ইসলাম থেকে যথেষ্ট দূরে ছিল। তবে যা-ই হোক, এখন জীবনতত্ত্ব ও আ-রহস্য মহাজাগতিক তত্ত্ব ও গুপ্ততত্ত্বের ব্যাপারে দৃষ্টির সম্মুখে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে গেল। বস্তুবাদ, অজ্ঞতাবাদ ও সংশয়বাদের যে গগনচুম্বী সৌধ বছরের পর বছর ধরে নির্মিত হয়েছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। অন্তকরণে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেল যে বস্তুবাদের বাইরে এবং তার চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে আরেকটি জগৎ আছে, তা হলো―আধ্যাত্মিক জগৎ । পঞ্চইন্দ্রিয়ের দেখা-শোনা ও ধরা-ছোঁয়াই সবকিছু নয়। এসবের অতল তলে এসবের বহু ঊর্ধ্বে গায়েব-অদৃশ্য ও দৃষ্টিশক্তির ধরা-ছোঁয়ার বাইরে একটি স্বতন্ত্র জগতের অস্তিত্ব বিদ্যমান। মহাগ্রন্থ আল কোরআন একেবারে সূচনাতে যে ঈমানের কথা বর্ণনা করেছে, তা-তে ‘ঈমান বিল গায়ব’ বা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপনের গুণের কথা বলেছে, তা অত্যন্ত সারগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমে স্বয়ং গায়েব এর প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস তো থাকতে হবে। তারপর তার শাখা-প্রশাখা ও বিশদ বিবরণ অবগতি লাভ হতে থাকবে।
আমাদের মাওলানা সাহেবরা হয়তো আমার এই ধাপ ও পর্যায়কে অবমূল্যায়ন করতে পারেন। কিন্তু বস্তুত এটাই ছিল সংশয়বাদ ও নাস্তিকতার লশকরের বিরুদ্ধে ঈমান-আকীদা ও আধ্যাত্মিকতার বিরাট ও প্রকাশ্য বিজয়।
এই পর্ব ও অধ্যায়ের সবেমাত্র সূচনা, ইতিমধ্যে আল্লামা শিবলীর সীরাতুন্নবীর প্রথম খ- প্রেস থেকে ছেপে পাঠকদের হাতে চলে এসেছে। গ্রন্থটি ছিল শিবলীর মতো মনীষীর কলমে রচিত; সুতরাং বিষয়বস্তু যা-ই হোক, তা কি আর পরম আগ্রহে না পড়ে থাকা যায়। তাই পরম আগ্রহে গ্রন্থটি হাতে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। আদ্যোপান্ত পড়ে শেষ করা পর্যন্ত দম ফেললাম না। মনের আসল চোর তো এখানেই ছিল। দুর্ভাগা প্রবৃত্তি সবচেয়ে বড় যে হোঁচট খেয়েছিল, তা তো এই পবিত্র সীরাতের ব্যাপার নিয়েই ছিল। প্রাচ্যবিদ ও ইউরোপীয় গবেষকদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু তো প্রিয়তম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সত্তাই ছিল। বিশেষত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুদ্ধ-বিগ্রহসমূহের ব্যাপারে মতলববাজ লেখকরা তো বিভিন্নভাবে মন-মস্তিষ্কে এ কথা বদ্ধমূল করে দিয়েছিল যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক একজন জালেম বিজেতার চেয়ে আলাদা কিছু ছিলেন না (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লামা শিবলী তার গ্রন্থে এই ব্যথারই অব্যর্থ প্রতিষেধক দিয়েছেন। ওই যখমের ওপরই মলমের শীতল প্রলেপ দিয়েছেন। আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতের টুকরোয় পরিণত করে দিন।
বই যখন বন্ধ করলাম, তখন কল্পনার চোখে রাসূলে আরাবীর যে চিত্র ভেসে উঠল, তা ছিল দেশ ও জাতির এক মহান সংস্কারক এবং এক উদার ও দয়ালু শাসকের চিত্র, যাকে যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়াতে হয়েছে তো একেবারে শেষ পর্যায়ে জড়াতে হয়েছে। একেবারে অনন্যোপায় হয়ে। এই মর্যাদা নিঃসন্দেহে আজ প্রত্যেক মুসলমানের কাছে অনেক কম ও নিচে মনে হবে এবং এ ক্ষেত্রে লেখক শিবলীর কোনো মূল্য ও অবদান নজরে পড়বে না। কিন্তু এর মূল্য একটু ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, যার অন্তর―নাউযুবিল্লাহ―প্রিয়নবীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। শিবলীর এই গ্রন্থের অনুগ্রহ আমি কখনো ভুলতে পারব না। বিশ্বাসীদের কাছে আবু তালিবের মর্যাদা যতটাই থাকুক আর যে পরিমাণই হোক, আবু লাহাব ও আবু জাহেলের শত্রুতার সঙ্গে তার কোনো তুলনাই চলতে পারে না।
এই পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কেবল বইপুস্তকের আলোচনাই হয়েছে, এখন কিছুক্ষণের জন্য মূল আলোচনা থেকে সরে গিয়ে ওই সকল ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের নাম শুনে নেওয়া যাক, যারা এই ক্রান্তিকালে আমার ও ইসলামের মধ্যে দূরত্ব ঘুচাতে সহায় হয়েছেন। স্বভাবতই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে যে আমার সম্পর্ক যখন মুসলমান আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যথারীতি বহাল ছিল, তাহলে এদের অধিকাংশই আমার এ দুর্যোগে কেন নীরব রইল, তারা প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে কেন তাবলীগের গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিল না? উত্তরে প্রথমত অনেকটা মুসলিম সমাজের ব্যাপক গাফলত ও উদাসীনতা, নির্জীবতা ও স্থবিরতা, অনুভূতিশূন্যতা ও মনরক্ষার একধরনের ভুল রীতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত আপন সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী অনেকে হাত-পা মেরেছে, কিন্তু আমার নিকট তা গ্রাহ্যই হয়নি। তাই আমার উপর কারও চেষ্টা ও তদবীরের প্রভাব পড়বে কোত্থেকে। লখনৌর ফিরিঙ্গি মহলের এক বিখ্যাত মাওলানা সাহেব, ইউপির এক বিখ্যাত পীর সাহেব, দিল্লীর এক প্রসিদ্ধ বুযুর্গ―এরা সকলেই আমাকে ধরতে আপন আপন শিকার-জাল ফেলেছেন, কিন্তু আমি কারও কাছেই ধরা দিইনি।
ہرچہ كردند ازعلاج وازدوا
ربح افزوں گشت وحاجت ناروا
রোগ নিরাময়ে যতই দাওয়াইর প্রয়োগ চলতে লাগল ততই রোগ বাড়তে থাকল এবং নানা বিপত্তি দেখা দিতে থাকল।
তবে হ্যাঁ, কারও আন্তরিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ চেষ্টা তদবীর যদি চুপে চুপে কাজে করে, তাহলে শুধু এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে : এক. এলাহাবাদের বিখ্যাত রসিক কবি জনাব আকবর এলাহাবাদী রহ.―তিনি কখনো তর্ক-বিতর্কের ছায়াও মাড়াননি। আর না কখনো নসীহত ও উপদেশের ঝুলি খুলেছেন। শুধু সময়ে সুযোগে চুপে চুপে আপন মধুর ভঙ্গিতে এমন দু-চারটি কথা বলতেন, যা হৃদয়ে গেঁথে যেত। আর মন-মস্তিষ্কে যে ঝাঁকুনি দিত, তাতে আর যা-ই হোক, হক ও সত্য কবুল করে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হতে থাকত। একদিন বললেন―‘জনাব, আপনি তো কলেজে বিষয় হিসেবে আরবী ভাষাকেও গ্রহণ করেছিলেন। এখন কি তার সঙ্গে সম্পর্ক বহাল আছে? বিদ্যা ও ভাষা যেটাই হোক তার তো মূল্যায়ন করা উচিত।’
আমি বললাম―‘এখন আর তা চর্চা করার সময় কোথায়?’
তিনি বললেন―‘তা এমন কঠিন কিছু তো নয়। কোরআন শরীফের অনুপম সাহিত্যকে তো ইউরোপীয়রাও স্বীকার করে। আমি শুনেছি জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরবী সাহিত্যের কোর্সে কোরআন শরীফের শেষ পনেরো পারাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আপনি আকীদা-বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে না হোক, অন্তত আরবী সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে কোরআন শরীফের সঙ্গে বন্ধন অটুট রাখুন। দৈনিক যে কয় মিনিট সময় বের করতে পারেন, তাতেই কিছুটা পড়ে নেবেন। যে যে জায়গা বুঝে না আসবে তা ছেড়ে দেবেন, আর এ কথা ধরে নেবেন যে ওই অংশগুলো আপনার জন্য নয়। এভাবে পাঠ অব্যাহত রাখলে দু-একটি বাক্য আপনার ভালো লেগেই যাবে; ব্যস, ওই বাক্যগুলো দু-চার বার পড়ে নেবেন। আর আপনার জন্য ওযু করে পড়ার শর্তও রক্ষা করতে হবে না।’
এ হলো তার তাবলীগের একটি নমুনা।
দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব হলেন―বিখ্যাত দেশবরেণ্য নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার রহ.। বড় জোরদার ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। আর আমার তো একপ্রকার প্রিয়তম ব্যক্তিই ছিলেন। কখনো চিঠিতে, কখনো মুখে যখনই সামান্য সুযোগ পেতেন, বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কখনো হেসে, কখনো গর্জন করতে করতে, কখনো চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তাবলীগের কাজে সেরে ফেলতেন। তাঁর উন্নত মস্তিষ্ক, প্রখর ধীশক্তি, শাণিত বুদ্ধি, গভীর জ্ঞান এবং নিখাদ ইখলাস ও আন্তরিকতা পূর্ব থেকেই আমার নিকট স্বীকৃত ছিল। তাই এই দুই মনীষীর তাবলীগ কখনো ভারী ও কষ্টকর মনে হয়নি। তাঁরা নসিহত ও কল্যাণকামিতার হক পুরোপুরি আদায় করে পুণ্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছিলেন। এই দুই মহান গুরুভার ব্যক্তিত্বের পর তৃতীয় আরেকটি নাম শুনে নিন। তিনি হলেন আমার প্রিয় সঙ্গী মাওলানা আব্দুল বারী নদভী। আর সেই তিনি আজ (১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে) মাওলানা শাহ আব্দুল বারী, খলীফায়ে থানভী হিসেবে সারা দেশে সমধিক পরিচিত। ধীরে ধীরে তাঁর ভালোই প্রভাব পড়ছিল। চতুর্থ জন হিসেবে একজন অমুসলিম ব্যক্তিত্বের নাম না নিলেই নয়। তিনি হলেন বেনারসের বিদগ্ধ দার্শনিক সন্ন্যাস বাবু ভগবান দাস। বস্তুবাদের অতল গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে এবং আধ্যাত্মিকতার আলোকরৌশনিতে পৌঁছতে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। তার লেখা ও রচনা দ্বারা উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি প্রায়শই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ ঘটত।
গীতা অধ্যয়নের সুবাদে মন-মানসিকতায় সূফীবাদের প্রতি একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। অলি-বুযুর্গদের কারামত ও অলৌকিক ঘটনার ব্যাপারে এখন আর বিরূপ মনোভাব ছিল না; বরং এসবের প্রতি একটা ঝোঁক ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। আর এ সম্পর্কে উর্দু-ফার্সীতে অনেক বই-পুস্তকও পড়া হয়ে গিয়েছিল।
অন্তর্জগৎ ও মনোজগতে গভীর প্রভাব বিস্তারকারী উল্লেখযোগ্য মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হলেন, দেওয়া অঞ্চলের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হাজী ওয়ারেছ আলী শাহ। তার বাণীসঙ্কলন বড় মুগ্ধ নয়নে পড়তাম। স্বচ্ছ ও পরিষ্কার ধারণা নিয়ে সচেতনভাবে মুসলমান হওয়ার আগেই তাঁর কারামত ও অলৌকিক ঘটনাবলি আগ্রহভরে শুনতে লাগলাম। ১৯১৯ সনের শেষের দিকের কথা। লখনৌর বাসিন্দা এক নিকটাত্মীয় সৈয়দ মমতাজ আহমদের নিকট কানপুরের ঝকঝকে ছাপা, সুন্দর বাঁধাইয়ের মাওলানা রুমীর অমর কাব্যগ্রন্থ মসনবী শরীফের পুরো ছয় দফতর দেখতে পেলাম। পাঠের পুরোনো অভ্যাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বেচারা বড় খুশি খুশি এক এক দফতর দিতে শুরু করল। গ্রন্থখানা অধ্যয়ন শুরু করতে দেরি ছিল, কিন্তু এ কথা মনে হতে দেরি হলো না যে কে যেন আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছে। গ্রন্থখানা আমি রেখে উঠতে চাইলেও গ্রন্থখানা আমাকে ছাড়ে না। তখন ফার্সীভাষায় যোগ্যতাই বা কতখানি ছিল। হাজারো কবিতার আগা-মাথার কিছুই বুঝে আসত না কিন্তু তবুও তার আকর্ষণ ও সম্মোহন এতই প্রবল ছিল যে একপ্রকার আত্মহারা হয়ে পড়ে চলেছি এবং গ্রন্থখানা থেকে চোখ আলগ করতে পারছি না। এই অস্পষ্ট ও ভাসাভাসা বুঝেই সম্পূর্ণ আত্মহারা হয়ে একপ্রকার মত্ততা অনুভব করতে লাগলাম। কোথায় নাওয়া-খাওয়া আর কোথায়-নিদ্রা বিশ্রাম। মনেপ্রাণে শুধু একই কামনা―রুদ্ধদ্বারে নির্জনে অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে পারা। পড়তে পড়তে কখনো চোখের পানিতে ভেসে যাওয়া, আর কখনো অজান্তেই চিৎকার করে ওঠা। গ্রন্থখানার টীকা ছিল আরও মারাত্মক। উপরন্তু তা ছিল ‘মুরশিদুনা কেবলায়ে আলম’ এর কলমে লেখা। দেখতে সংক্ষিপ্ত, কয়েক শব্দের। কিন্তু ছিল পুরো পঙ্ক্তির সারনির্যাস। (পরে জানতে পারি ‘মুর্শিদুনা’ হলেন যুগশ্রেষ্ঠ অলি, মহান বুযুর্গ হাজী এমদাদুল্লাহ মুহজিরে মক্কী রহ.) মনে নেই গ্রন্থখানা কত দিনে খতম হয়েছে। যখনই শেষ হয়ে থাক, তবে এতটুকু মনে পড়ে―অন্তর মমতাজ মিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতায় টইটুম্বুর ছিল। কারণ, এই অমূল্য রত্ন তার মাধ্যমেই প্রাপ্ত হয়েছিলাম। কোনো প্রকার তর্ক-বিতর্ক ছাড়াই সংশয়-সন্দেহের ছিটেফোঁটা আর অন্তরে বাকি রইল না। অন্তরাত্মা তখন মসনবী রচয়িতার প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাস স্থাপনে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। যেন খোদা এবং রাসূল সবই তিনি (নাউযুবিল্লাহ)। প্রকৃত অর্থে যদিও তখনো মুসলমান হয়নি কিন্তু কুফর ও কুফুরী মতবাদ থেকে অন্তর পুরোপুরি সরে গিয়েছিল। সংশয়বাদ ও ইউরোপীয় নাস্তিকতাকে শতমুখে অভিশাপ দিচ্ছিল।
ধারাবাহিক পরিবর্তনের এই ধাপ ও পর্যায়ে এসে তাসাউফের অনেক ফার্সী বই-পুস্তক পড়ে ফেললাম। ফরীদুদ্দীন আত্তারের মানতিকুত তাইর, জামীর নফহাতুল উনস ইত্যাদি। অদ্ভুত ও অলৌকিক ঘটনাবলি হৃদয়কে নাড়া দিত। অন্তরাত্মাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। কাশফ ও কারামতের ঘটনাবলি গভীর আগ্রহ এবং পরম ভক্তি ও বিশ্বাস নিয়ে শ্রবণ করতাম। লখনৌর ওই বাড়িতে নাঈমুযযামান নামে আমার এক খালাত ভাই এসে অবস্থান করত। ও নিজেই একটা সূফীবিশ্বকোষ ছিল, তার সান্নিধ্য সোনায় সোহাগার কাজ দিল। সময় সময় মাজারে যাওয়া, ওরস ও কাওয়ালিতে অংশগ্রহণ করা শুরু হয়ে গেল। লখনৌতেও লখনৌর বাইরে দেওয়া অঞ্চলে হাজী ওয়ারিস আলী শাহকে তো কিছুকাল পর্যন্ত সর্বত্র হাযির-নাযির মনে করতাম (নাউযুবিল্লাহ)! ইসলাম থেকে দূরত্ব এখন দিন দিন কমতে থাকল এবং প্রতি পদক্ষেপ তারই পানে ধাবিত হচ্ছিল। হোক তা কবরপূজা ও পীরপূজার হাত ধরে।
ইসলামে প্রত্যাবর্তন
পর্যায়ক্রমিক অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ধীরে ধীরে ইসলামের পানে অগ্রসর হচ্ছি, বলা যায় পঞ্চাশ ভাগের বেশি মুসলমান হয়ে গিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে ১৯২০ এর অক্টোবরে এক আত্মীয় নাযিরয়ার জঙ্গের বাসায় এবং আওরাঙ্গবাদে অবস্থানের সুযোগ হয়। তার গ্রন্থাগারে মুহাম্মদ আলী লাহোরী আহমদীকৃত (সাধারণ্যে কাদিয়ানী হিসেবে খ্যাত) কোরআন শরীফের ইংরেজী অনুবাদ ও তাফসীর নজরে পড়ল। ব্যাকুল হয়ে তা আলমারী থেকে বের করে পড়া শুরু করলাম, অধ্যয়ন যতই অগ্রসর হচ্ছিল―আলহামদুলিল্লাহ―ঈমান ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তখন পর্যন্ত ‘বাবুয়ানা মানসিকতায়’ আক্রান্ত ছিলাম, তারই প্রতিক্রিয়া ছিল, যে অর্থ-মর্ম ও তাৎপর্য উর্দুতে নিষ্প্রাণ ও প্রতিক্রিয়াহীন মনে হতো, ঠিক তা-ই ইংরেজির মোড়কে ক্রিয়াশীল, প্রাণবন্ত ও সুদূর প্রভাবীতে পরিণত হতো। এটা কোনো মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা হোক বা না হোক, আমার বেলায় তা প্রত্যক্ষ বাস্তবতা বলে প্রতীয়মান হয়েছে―এই ইংরেজি তরজমা সমাপ্ত করে অন্তরে তন্ন তন্ন করে তল্লাশী চালিয়ে নিজেকে মুসলমান বলেই আবিষ্কার করেছি। আর তখন আপন বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা না করে নির্দ্বিধায় কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে নিয়েছিলাম।
মির্যা কাদিয়ানীর ব্যাপারে তার আকীদা ভ্রান্ত ছিল, না সঠিক ছিল এ নিয়ে আমার আলোচনা নয়। ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে কী করে আর উপেক্ষা করা যায়; কারণ, আমার কুফর ও ধর্মদ্রোহের কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার কাজটি এর মাধ্যমেই ঘটেছে। একদা ইসলাম থেকে সন্তর্পণে চুপিসারে যেমন বেরিয়ে গিয়েছিলাম, মহান আল্লাহ পাকের অশেষ কৃপায় আজ তেমনি ধীরে ধীরে ইসলামে দাখেল হয়ে গেলাম। ইসলামত্যাগ ও ধর্মদ্রোহের সময়টাকে যেমন দিন-তারিখ দিয়ে সুনির্দিষ্ট করা কঠিন, তদ্রূপ ইসলামে প্রত্যাবর্তনের সময়টিকে দিন-তারিখ দিয়ে কাঁটায় কাঁটায় স্থির নির্দিষ্ট করা সহজ নয়। তবে ১৯২০ অক্টোবরে তা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছিল। ভ্রষ্টতা অধ্যয়নের পথ ধরেই এসেছিল, আলহামদুলিল্লাহ, হেদায়াতও এ পথেই নছীব হয়েছে। কবি আকবর এলাহাবাদীর কালজয়ী পঙ্ক্তি―
دل بدل جائیں گے تعلیم بدل جانے سے
শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের দ্বারা মানসিকতা বদলে যাবে।
আমার আত্মজীবনী দ্বারা তা পুরোপুরি সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, আমার এত বৈপ্লবিক পরিবর্তনে জীবন্ত ব্যক্তির বড় একটা ভূমিকা ছিল না।
হিন্দুদর্শন ও যোগবাদী তাসাউফ কুফুর ও ঈমানের মধ্যে অনেকটা সেতুবন্ধনের কাজ দিয়েছে। যে শুষ্ক ধার্মিকগণ হিন্দুদর্শনের নাম শুনতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, আর একে আগাগোড়া কুফুরী ও ভ্রষ্টতা আখ্যায়িত করে থাকেন তারা আমার অভিজ্ঞতা গুরুত্বসহকারে নোট করে রাখতে পারেন যে একে (হিন্দুদর্শন ও যোগবাদকে) সহজেই হেদায়াতের মাধ্যম বানানো যেতে পারে। আর তাঁরা যেন নিজেদের ধার্মিকতার জোশে আল্লামা শিবলী ও মুহাম্মদ আলী লাহোরীর তাবলীগী অবদানকে তাচ্ছল্যভরে উড়িয়ে না দেন। আমি তো এ দুজনের বিরাট সহায়তা অনুভব করেছি। এমনকি স্পিরিট অফ ইসলামের লেখক জাস্টিস আমীর আলীর কর্ম ও অবদানকেও হেয় ও তুচ্ছ মনে করবেন না। অথচ ওই বেচারা কোরআন শরীফকেও সম্ভবত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীসঙ্কলন মনে করত। আপন জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের সারকথা এটাই যে চিন্তা ও মন-মানসিকতার যে স্তরে তখন ছিলাম, সেখানে হযরত থানভী রহ. এর মতো মনীষীর লেখা ও রচনা ভ্রুক্ষেপের অযোগ্যই ঠাওরাতাম। ওসব দিকে চোখ তুলেও তাকাতাম না। বরং তার ওয়াজ-নসীহত থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করতাম।
খাদ্য উপাদেয় ও শক্তিবর্ধক এ কথা সত্য, তবে যদি রোগীর পাকস্থলীর উপযোগী না হয়, তাহলে তো তাতে উল্টো ক্ষতিই হবে। ঈমানের মহামূল্যবান দৌলত তো নছীব হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তখনো প্রথাগত পীর-মুরীদী, দরগাহ ও দরবার-কেন্দ্রিক হয়ে মাথা ঠুকছিল। দরগাহ ও মাজারে হাযিরা দেওয়া, বার্ষিক ওরস-কাওয়ালীতে অংশগ্রহণ বড় জোরে শোরে চলছিল। আজ আজমিরে হাযিরা দিলে কাল খাজা বখতিয়ার কাকীর দরগাহে। অনুরূপ লখনৌর দরগাহ ও দরবারসমূহ (শাহ মীনার দরগাহে, সূফী আবদুর রহমানের দরগাহে) ফিরতে থাকি। লখনৌর পাশ্ববর্তী অঞ্চলের মাযারসমূহে যেমন রুদূলীর মাযার, বাঁনসা এলাকার মাযার এবং দেওয়ার দরগায় ঘন ঘন চক্কর লাগাতে থাকি। বিশেষ নিসবত ও সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছিল খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়ার সঙ্গে, সেই সুবাদে সর্বদা খাজা হাসান নিজামীর মেহমান হতে থাকি। ১৯২১ এর সূচনালগ্নে লখনৌ থেকে দরিয়াবাদে চলে আসি এবং একেই স্থায়ী নিবাস হিসেবে গ্রহণ করি। পর পর দু বছর আপন প্রধান পূর্বপুরুষ মাখদুম আ-বখশ দরিয়াবাদীর ওরস পালন করেছি। বড় ধুমধামের সঙ্গে এবং জোরদার কাওয়ালী মাহফিলের আয়োজন করেছি। ১৯২২ এর প্রথম ত্রৈমাসিক ছিল, ওয়াজ ও ভাবোদ্দীপক কিছু নাত ও গযল মাওলানা মুহাম্মদ আলীর হাতে পড়ে গেল। এতে করে তিনি নিজেও গযল গাইলেন। কাওয়ালী গায়কদের দিয়েও গাওয়ালেন। ঘটনাক্রমে দরিয়াবাদেও হাতের কাছে সহজেই ভালো ভালো কাওয়ালী গায়ক পাওয়া গেল। তন্মধ্যে কাওয়ালীগায়ক মরহুম আফজাল সাহেব উল্লেখযোগ্য। কাওয়ালী শোনা দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আত্মহারা হয়ে রোনাজারির হালত হতে লাগল। বিশেষত ভোর-সকালের লোকারণ্যে।
নাত-গযলের ক্ষেত্রে তো পরিষ্কার মনে আছে যে সর্বপ্রথম যে বিষয়বস্তু শুনে বেএখতিয়ার অশ্রুপ্রবাহ শুরু হয়ে গিয়েছিল তা ছিল মাওলানা জামী রহ.এর বিখ্যাত গযলের উদ্বোধনী পঙ্ক্তি―
بہ خرام باز جلوہ دہ آں سرونازرا
پامال خویش کش سر اہل نیاز را
প্রেমবাজিকরের উচিত ওই ঢং ও ভঙ্গিমা প্রদর্শন করা অর্থাৎ প্রিয়তমের সম্মুখে আপন সত্তাকে বিলীন করে দাও।
পর্যায়ক্রমিক অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ধীরে ধীরে ইসলামের পানে অগ্রসর হচ্ছি, বলা যায় পঞ্চাশ ভাগের বেশি মুসলমান হয়ে গিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে ১৯২০ এর অক্টোবরে এক আত্মীয় নাযিরয়ার জঙ্গের বাসায় এবং আওরাঙ্গবাদে অবস্থানের সুযোগ হয়। তার গ্রন্থাগারে মুহাম্মদ আলী লাহোরী আহমদীকৃত (সাধারণ্যে কাদিয়ানী হিসেবে খ্যাত) কোরআন শরীফের ইংরেজী অনুবাদ ও তাফসীর নজরে পড়ল। ব্যাকুল হয়ে তা আলমারী থেকে বের করে পড়া শুরু করলাম, অধ্যয়ন যতই অগ্রসর হচ্ছিল―আলহামদুলিল্লাহ―ঈমান ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তখন পর্যন্ত ‘বাবুয়ানা মানসিকতায়’ আক্রান্ত ছিলাম, তারই প্রতিক্রিয়া ছিল, যে অর্থ-মর্ম ও তাৎপর্য উর্দুতে নিষ্প্রাণ ও প্রতিক্রিয়াহীন মনে হতো, ঠিক তা-ই ইংরেজির মোড়কে ক্রিয়াশীল, প্রাণবন্ত ও সুদূর প্রভাবীতে পরিণত হতো। এটা কোনো মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা হোক বা না হোক, আমার বেলায় তা প্রত্যক্ষ বাস্তবতা বলে প্রতীয়মান হয়েছে―এই ইংরেজি তরজমা সমাপ্ত করে অন্তরে তন্ন তন্ন করে তল্লাশী চালিয়ে নিজেকে মুসলমান বলেই আবিষ্কার করেছি। আর তখন আপন বিবেকের সঙ্গে প্রতারণা না করে নির্দ্বিধায় কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে নিয়েছিলাম।
মির্যা কাদিয়ানীর ব্যাপারে তার আকীদা ভ্রান্ত ছিল, না সঠিক ছিল এ নিয়ে আমার আলোচনা নয়। ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে কী করে আর উপেক্ষা করা যায়; কারণ, আমার কুফর ও ধর্মদ্রোহের কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার কাজটি এর মাধ্যমেই ঘটেছে। একদা ইসলাম থেকে সন্তর্পণে চুপিসারে যেমন বেরিয়ে গিয়েছিলাম, মহান আল্লাহ পাকের অশেষ কৃপায় আজ তেমনি ধীরে ধীরে ইসলামে দাখেল হয়ে গেলাম। ইসলামত্যাগ ও ধর্মদ্রোহের সময়টাকে যেমন দিন-তারিখ দিয়ে সুনির্দিষ্ট করা কঠিন, তদ্রূপ ইসলামে প্রত্যাবর্তনের সময়টিকে দিন-তারিখ দিয়ে কাঁটায় কাঁটায় স্থির নির্দিষ্ট করা সহজ নয়। তবে ১৯২০ অক্টোবরে তা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছিল। ভ্রষ্টতা অধ্যয়নের পথ ধরেই এসেছিল, আলহামদুলিল্লাহ, হেদায়াতও এ পথেই নছীব হয়েছে। কবি আকবর এলাহাবাদীর কালজয়ী পঙ্ক্তি―
دل بدل جائیں گے تعلیم بدل جانے سے
শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের দ্বারা মানসিকতা বদলে যাবে।
আমার আত্মজীবনী দ্বারা তা পুরোপুরি সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, আমার এত বৈপ্লবিক পরিবর্তনে জীবন্ত ব্যক্তির বড় একটা ভূমিকা ছিল না।
হিন্দুদর্শন ও যোগবাদী তাসাউফ কুফুর ও ঈমানের মধ্যে অনেকটা সেতুবন্ধনের কাজ দিয়েছে। যে শুষ্ক ধার্মিকগণ হিন্দুদর্শনের নাম শুনতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, আর একে আগাগোড়া কুফুরী ও ভ্রষ্টতা আখ্যায়িত করে থাকেন তারা আমার অভিজ্ঞতা গুরুত্বসহকারে নোট করে রাখতে পারেন যে একে (হিন্দুদর্শন ও যোগবাদকে) সহজেই হেদায়াতের মাধ্যম বানানো যেতে পারে। আর তাঁরা যেন নিজেদের ধার্মিকতার জোশে আল্লামা শিবলী ও মুহাম্মদ আলী লাহোরীর তাবলীগী অবদানকে তাচ্ছল্যভরে উড়িয়ে না দেন। আমি তো এ দুজনের বিরাট সহায়তা অনুভব করেছি। এমনকি স্পিরিট অফ ইসলামের লেখক জাস্টিস আমীর আলীর কর্ম ও অবদানকেও হেয় ও তুচ্ছ মনে করবেন না। অথচ ওই বেচারা কোরআন শরীফকেও সম্ভবত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীসঙ্কলন মনে করত। আপন জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের সারকথা এটাই যে চিন্তা ও মন-মানসিকতার যে স্তরে তখন ছিলাম, সেখানে হযরত থানভী রহ. এর মতো মনীষীর লেখা ও রচনা ভ্রুক্ষেপের অযোগ্যই ঠাওরাতাম। ওসব দিকে চোখ তুলেও তাকাতাম না। বরং তার ওয়াজ-নসীহত থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করতাম।
খাদ্য উপাদেয় ও শক্তিবর্ধক এ কথা সত্য, তবে যদি রোগীর পাকস্থলীর উপযোগী না হয়, তাহলে তো তাতে উল্টো ক্ষতিই হবে। ঈমানের মহামূল্যবান দৌলত তো নছীব হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তখনো প্রথাগত পীর-মুরীদী, দরগাহ ও দরবার-কেন্দ্রিক হয়ে মাথা ঠুকছিল। দরগাহ ও মাজারে হাযিরা দেওয়া, বার্ষিক ওরস-কাওয়ালীতে অংশগ্রহণ বড় জোরে শোরে চলছিল। আজ আজমিরে হাযিরা দিলে কাল খাজা বখতিয়ার কাকীর দরগাহে। অনুরূপ লখনৌর দরগাহ ও দরবারসমূহ (শাহ মীনার দরগাহে, সূফী আবদুর রহমানের দরগাহে) ফিরতে থাকি। লখনৌর পাশ্ববর্তী অঞ্চলের মাযারসমূহে যেমন রুদূলীর মাযার, বাঁনসা এলাকার মাযার এবং দেওয়ার দরগায় ঘন ঘন চক্কর লাগাতে থাকি। বিশেষ নিসবত ও সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছিল খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়ার সঙ্গে, সেই সুবাদে সর্বদা খাজা হাসান নিজামীর মেহমান হতে থাকি। ১৯২১ এর সূচনালগ্নে লখনৌ থেকে দরিয়াবাদে চলে আসি এবং একেই স্থায়ী নিবাস হিসেবে গ্রহণ করি। পর পর দু বছর আপন প্রধান পূর্বপুরুষ মাখদুম আ-বখশ দরিয়াবাদীর ওরস পালন করেছি। বড় ধুমধামের সঙ্গে এবং জোরদার কাওয়ালী মাহফিলের আয়োজন করেছি। ১৯২২ এর প্রথম ত্রৈমাসিক ছিল, ওয়াজ ও ভাবোদ্দীপক কিছু নাত ও গযল মাওলানা মুহাম্মদ আলীর হাতে পড়ে গেল। এতে করে তিনি নিজেও গযল গাইলেন। কাওয়ালী গায়কদের দিয়েও গাওয়ালেন। ঘটনাক্রমে দরিয়াবাদেও হাতের কাছে সহজেই ভালো ভালো কাওয়ালী গায়ক পাওয়া গেল। তন্মধ্যে কাওয়ালীগায়ক মরহুম আফজাল সাহেব উল্লেখযোগ্য। কাওয়ালী শোনা দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আত্মহারা হয়ে রোনাজারির হালত হতে লাগল। বিশেষত ভোর-সকালের লোকারণ্যে।
নাত-গযলের ক্ষেত্রে তো পরিষ্কার মনে আছে যে সর্বপ্রথম যে বিষয়বস্তু শুনে বেএখতিয়ার অশ্রুপ্রবাহ শুরু হয়ে গিয়েছিল তা ছিল মাওলানা জামী রহ.এর বিখ্যাত গযলের উদ্বোধনী পঙ্ক্তি―
بہ خرام باز جلوہ دہ آں سرونازرا
پامال خویش کش سر اہل نیاز را
প্রেমবাজিকরের উচিত ওই ঢং ও ভঙ্গিমা প্রদর্শন করা অর্থাৎ প্রিয়তমের সম্মুখে আপন সত্তাকে বিলীন করে দাও।
প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর নাম মোবারক শুনে বে-এখতিয়ার চোখ টলমল করে অশ্রু-প্রবাহ জারি
হওয়ার কথাও মনে পড়ে। স্বপ্নযোগে মরহুম বুযুর্গদের বহুবার সাক্ষাৎ লাভ
করেছি। আর অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী জীবিত আধ্যাত্মিক পীর-মাশায়েখদের যিয়ারতও
বারংবার হতে থাকে।
ঈমান ও ইসলামের পথের যাত্রায় ক্রমপরিবর্তনের অধ্যায়টি আড়াই কি তিন বছর স্থায়ী হয়, সময়টা সম্ভবত ১৯২৩ এর সেপ্টেম্বর মাস ছিল, ওই সময় মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মাকতুবাত অধ্যয়ন করার তৌফিক হয়। দামী কাগজে উন্নত বাঁধাইয়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা ঝকঝকে ছাপা চমৎকার একটি কপি। অমৃতসর থেকে ছাপা টীকাসহ (কানপূর থেকে ছাপা মসনবীর এ্যাডিশনের মতো) নয় খণ্ডে পেয়ে গেলাম। এও মনের মধ্যে প্রায় তেমনি গভীর দাগ কেটেছে যেমন দাগ কেটেছিল তিন-চার বছর পূর্বে মসনবী শরীফ। পার্থক্য শুধু এতটুকু ছিল যে মসনবী জোশ ও মাস্তির এক অত্যুষ্ণ তাপ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। (মাকতুবাতের কল্যাণে) উদভ্রান্তের মতো এদিক-সেদিক ছোটাছুটি এবং প্রত্যেক মাজারওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক পাতানোর পরিবর্তে শরীয়ত অনুসরণের সুনির্দিষ্ট রাজপথ পেয়ে গেলাম। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য, অভীষ্ট লক্ষ্য স্থির হয়ে গেল, আর তা হলো―রেজায়ে এলাহী ও আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি। ওই গন্তব্যে পৌঁছা এবং সেই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র মাধ্যম হলো, আখেরী নবী আনীত বিধানাবলি। মসনবী ও মাকতুবাত―এতদুভয়ের অনুগ্রহ জীবনভর ভুলতে পারব না। বলা যায়, হেদায়াত যা কিছু ভাগ্যে জুটেছে চূড়ান্ত পর্যায়ে এই দুই গ্রন্থ অধ্যয়নেরই ফল ও ফসল। আর তাও ঘটেছে কোনো উস্তাদের তত্ত্বাবধান ও পথনির্দেশ ছাড়া। আপন যোগ্যতার কমতির দরুন সবটাই রয়ে গেছে ভাসা ভাসা ও অগভীর।
এ পর্যায়ে এসে নিরেট ধর্মীয় বইপুস্তক অধ্যয়ন শুরু করলাম। কলেজে পড়ে আসা ভাঙাচোরা আরবী কাজে দিল। তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ও ইলমে কালামের গ্রন্থরাজির অধ্যয়ন বড় উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে করতে লাগলাম, অধিকাংশই উর্দু তরজমার সাহায্য নিয়ে। আলহামদুলিল্লাহ, এসব বিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ বই পুস্তক উর্দু ভাষায় অনুদিত হয়ে গেছে। কোরআন শরীফের উর্দু ও ফার্সী তরজমা হাতে পেয়ে গেলাম, সবগুলো একে একে মন্থন করে ফেললাম, তারপর বায়জাবী, কাশশাফ ইত্যাদি তাফসীরগ্রন্থের পালা এল। হাদীসের পুরো ভাণ্ডার মন্থনের সুযোগ ও সামর্থ্য আর কোথায় পাব। তবুও হাদীসের সহীহ কিতাবগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ও নির্বাচিত অংশগুলো আপন রুচি মোতাবেক কিছু না-কিছু অধ্যয়ন করেই নিয়েছি। তদ্রূপ ফিকহের প্রসিদ্ধ ও ব্যাপক সমাদৃত গ্রন্থরাজির দরকারি অংশগুলো টীকা, অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থের সাহায্যে পড়ে নিয়েছি। কোরআন শরীফের শব্দমালার অভিধান, হাদীসের অভিধান, ফিকহের অভিধান শ্রেণির যে কিতাবই হাতের কাছে পেয়েছি তা থেকেই সহযোগিতা নিতে শুরু করেছি। পড়া ও পড়ে শেষ করে ফেলার যে ‘ব্যাধি’ শুরু থেকেই ছিল, তা এ ক্ষেত্রেও বড় কাজে দিল। বুঝে না-বুঝে বহু পৃষ্ঠা মন্থন করে ফেলেছি।
লখনৌতে মৌলবী কাসমন্ডী নামে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একজন বুযুর্গ ছিলেন। বাহ্যত কালেক্টরির চাকরিতে কর্মরত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন। তার খেদমতে সীমাছাড়া রকমে পড়ে থাকতাম। ১৯২৯ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। বারাবানকী অঞ্চলের শহরতলীতে মৌলবী আবেদ হুসাইন ফতেহপুরী নামে একজন আলেম, শরীয়তের পাবন্দ, সাহেবে নিসবত বুযুর্গ ছিলেন। তিনি ১৯২৭ সনে ইন্তেকাল করেন। উক্ত দুই মহান মনীষী থেকেও আপন যোগ্যতা অনুযায়ী ফায়েদা হাসেল করেছি। সর্বাধিক ঈমানী ফায়েদা লাভ করেছি মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার থেকে। দেখতে না দরবেশ, না আলেম, না সংস্কারক কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হাতে গোনা দশজনের একজন। যেন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা ঈমানী উত্তাপের তন্দুর। ইশকে রাসূল ও ইশকে কোরআনকে আপন শয়ন ও স্বপন বানিয়ে নিয়েছিলেন। আমার ঈমান যদি প্রাণ পেয়ে থাকে, তা হলে তারই সান্নিধ্যের বরকতে প্রাণ পেয়েছে। ১৯২৩-১৯৩০ পর্যন্ত শেষ অবধি তাঁর সঙ্গে বারবার সাক্ষাতের ধারা অব্যাহত থেকেছে। বেশির ভাগই লখনৌ এবং দিল্লিতে। আর কখনো বম্বেতে কখনো আলীগড়েও। প্রতিটি সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্য ঈমান বৃদ্ধির কারণ হয়েছে। খেলাফত কমিটিতে জড়িয়ে পড়ার সূত্র ধরেই মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর সঙ্গে ১৯২৫ সনে পরিচয় ঘটে। তারপর লখনৌ, সাহারানপুর ও স্বয়ং দরিয়াবাদেও তাঁর পদধূলি লাভের সুযোগ হতে থাকে। ১৯২৮ সনে তার মাধ্যমেই হযরত থানভীর সোহবত ও সান্নিধ্যে উপনীত হই। হযরত থানভী রহ. থেকে দীনি রুহানী-আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক দিক থেকে যে পরিমাণ ফায়েদা হাসিল হয়েছে তা বর্ণনারও ঊর্ধ্বে। হযরতেরই একজন গুণী শিষ্য হাজী মুহাম্মদ শফী বিজনুরী (মৃত্যু : ১৯৫১) এতটাই হৃদ্যতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করেছেন, যেন আমি তার কোনো নিকটতম আত্মজন। আল্লাহ তাআলা এসব আল্লাহওয়ালাকে সর্বোচ্চ মাকাম ও মর্যাদা দান করুন, এক সাধারণ গোবেচারা পাপী-তাপী তাদের বিপুল অনুগ্রহ ও বদান্যতার বিনিময়ে তাদের জন্য কল্যাণের দুআ ছাড়া আর কীইবা করতে পারে।
ঈমান ও ইসলামের পথের যাত্রায় ক্রমপরিবর্তনের অধ্যায়টি আড়াই কি তিন বছর স্থায়ী হয়, সময়টা সম্ভবত ১৯২৩ এর সেপ্টেম্বর মাস ছিল, ওই সময় মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মাকতুবাত অধ্যয়ন করার তৌফিক হয়। দামী কাগজে উন্নত বাঁধাইয়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা ঝকঝকে ছাপা চমৎকার একটি কপি। অমৃতসর থেকে ছাপা টীকাসহ (কানপূর থেকে ছাপা মসনবীর এ্যাডিশনের মতো) নয় খণ্ডে পেয়ে গেলাম। এও মনের মধ্যে প্রায় তেমনি গভীর দাগ কেটেছে যেমন দাগ কেটেছিল তিন-চার বছর পূর্বে মসনবী শরীফ। পার্থক্য শুধু এতটুকু ছিল যে মসনবী জোশ ও মাস্তির এক অত্যুষ্ণ তাপ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। (মাকতুবাতের কল্যাণে) উদভ্রান্তের মতো এদিক-সেদিক ছোটাছুটি এবং প্রত্যেক মাজারওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক পাতানোর পরিবর্তে শরীয়ত অনুসরণের সুনির্দিষ্ট রাজপথ পেয়ে গেলাম। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য, অভীষ্ট লক্ষ্য স্থির হয়ে গেল, আর তা হলো―রেজায়ে এলাহী ও আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি। ওই গন্তব্যে পৌঁছা এবং সেই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র মাধ্যম হলো, আখেরী নবী আনীত বিধানাবলি। মসনবী ও মাকতুবাত―এতদুভয়ের অনুগ্রহ জীবনভর ভুলতে পারব না। বলা যায়, হেদায়াত যা কিছু ভাগ্যে জুটেছে চূড়ান্ত পর্যায়ে এই দুই গ্রন্থ অধ্যয়নেরই ফল ও ফসল। আর তাও ঘটেছে কোনো উস্তাদের তত্ত্বাবধান ও পথনির্দেশ ছাড়া। আপন যোগ্যতার কমতির দরুন সবটাই রয়ে গেছে ভাসা ভাসা ও অগভীর।
এ পর্যায়ে এসে নিরেট ধর্মীয় বইপুস্তক অধ্যয়ন শুরু করলাম। কলেজে পড়ে আসা ভাঙাচোরা আরবী কাজে দিল। তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ও ইলমে কালামের গ্রন্থরাজির অধ্যয়ন বড় উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে করতে লাগলাম, অধিকাংশই উর্দু তরজমার সাহায্য নিয়ে। আলহামদুলিল্লাহ, এসব বিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ বই পুস্তক উর্দু ভাষায় অনুদিত হয়ে গেছে। কোরআন শরীফের উর্দু ও ফার্সী তরজমা হাতে পেয়ে গেলাম, সবগুলো একে একে মন্থন করে ফেললাম, তারপর বায়জাবী, কাশশাফ ইত্যাদি তাফসীরগ্রন্থের পালা এল। হাদীসের পুরো ভাণ্ডার মন্থনের সুযোগ ও সামর্থ্য আর কোথায় পাব। তবুও হাদীসের সহীহ কিতাবগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ও নির্বাচিত অংশগুলো আপন রুচি মোতাবেক কিছু না-কিছু অধ্যয়ন করেই নিয়েছি। তদ্রূপ ফিকহের প্রসিদ্ধ ও ব্যাপক সমাদৃত গ্রন্থরাজির দরকারি অংশগুলো টীকা, অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থের সাহায্যে পড়ে নিয়েছি। কোরআন শরীফের শব্দমালার অভিধান, হাদীসের অভিধান, ফিকহের অভিধান শ্রেণির যে কিতাবই হাতের কাছে পেয়েছি তা থেকেই সহযোগিতা নিতে শুরু করেছি। পড়া ও পড়ে শেষ করে ফেলার যে ‘ব্যাধি’ শুরু থেকেই ছিল, তা এ ক্ষেত্রেও বড় কাজে দিল। বুঝে না-বুঝে বহু পৃষ্ঠা মন্থন করে ফেলেছি।
লখনৌতে মৌলবী কাসমন্ডী নামে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন একজন বুযুর্গ ছিলেন। বাহ্যত কালেক্টরির চাকরিতে কর্মরত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন। তার খেদমতে সীমাছাড়া রকমে পড়ে থাকতাম। ১৯২৯ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। বারাবানকী অঞ্চলের শহরতলীতে মৌলবী আবেদ হুসাইন ফতেহপুরী নামে একজন আলেম, শরীয়তের পাবন্দ, সাহেবে নিসবত বুযুর্গ ছিলেন। তিনি ১৯২৭ সনে ইন্তেকাল করেন। উক্ত দুই মহান মনীষী থেকেও আপন যোগ্যতা অনুযায়ী ফায়েদা হাসেল করেছি। সর্বাধিক ঈমানী ফায়েদা লাভ করেছি মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার থেকে। দেখতে না দরবেশ, না আলেম, না সংস্কারক কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হাতে গোনা দশজনের একজন। যেন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা ঈমানী উত্তাপের তন্দুর। ইশকে রাসূল ও ইশকে কোরআনকে আপন শয়ন ও স্বপন বানিয়ে নিয়েছিলেন। আমার ঈমান যদি প্রাণ পেয়ে থাকে, তা হলে তারই সান্নিধ্যের বরকতে প্রাণ পেয়েছে। ১৯২৩-১৯৩০ পর্যন্ত শেষ অবধি তাঁর সঙ্গে বারবার সাক্ষাতের ধারা অব্যাহত থেকেছে। বেশির ভাগই লখনৌ এবং দিল্লিতে। আর কখনো বম্বেতে কখনো আলীগড়েও। প্রতিটি সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্য ঈমান বৃদ্ধির কারণ হয়েছে। খেলাফত কমিটিতে জড়িয়ে পড়ার সূত্র ধরেই মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর সঙ্গে ১৯২৫ সনে পরিচয় ঘটে। তারপর লখনৌ, সাহারানপুর ও স্বয়ং দরিয়াবাদেও তাঁর পদধূলি লাভের সুযোগ হতে থাকে। ১৯২৮ সনে তার মাধ্যমেই হযরত থানভীর সোহবত ও সান্নিধ্যে উপনীত হই। হযরত থানভী রহ. থেকে দীনি রুহানী-আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক দিক থেকে যে পরিমাণ ফায়েদা হাসিল হয়েছে তা বর্ণনারও ঊর্ধ্বে। হযরতেরই একজন গুণী শিষ্য হাজী মুহাম্মদ শফী বিজনুরী (মৃত্যু : ১৯৫১) এতটাই হৃদ্যতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করেছেন, যেন আমি তার কোনো নিকটতম আত্মজন। আল্লাহ তাআলা এসব আল্লাহওয়ালাকে সর্বোচ্চ মাকাম ও মর্যাদা দান করুন, এক সাধারণ গোবেচারা পাপী-তাপী তাদের বিপুল অনুগ্রহ ও বদান্যতার বিনিময়ে তাদের জন্য কল্যাণের দুআ ছাড়া আর কীইবা করতে পারে।
ভাষান্তর : মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল