
এক. এরা নিজেরাই পাপাচার, দুর্নীতি ও অপরাধে লিপ্ত। শরীয়া আইন চালু হলে তারা শাস্তি পাবে বলে এ আইনের বিরোধিতা করে।
দুই. আরেক দল শরীয়া আইন সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না। তারা কেবল খুন, ব্যভিচার, নির্দোষ নারীকে অপবাদ দেয়া, মাদকগ্রহণ ও চুরির সাজাকেই শরীয়তের আইন বলে মনে করে; কিন্তু ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে এসব অপরাধ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পূর্বব্যবস্থা মজুদ রয়েছে এবং সুশাসন, ন্যায় বিচার, সামগ্রিক সংস্কার ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজ কলুষমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ করাই যে ইসলামের প্রধান কাজ তা তারা জানার সুযোগই পায়নি। সম্পূরক ব্যবস্থা হিসাবে যে কয়টি শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে তারা শুধু সেগুলোই মানুষের সামনে আলোচনা ও চর্চা করে থাকে।
সম্প্রতি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের আইন নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক অস্থিরতা। আমেরিকার একটি জরিপপ্রতিষ্ঠান বলেছে যে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ মুসলমান শরীয়া আইন পছন্দ করে। এটি অমুসলিমদের গবেষণা। মূলত প্রকৃত মুসলমানদের ১০০ ভাগই শরীয়া আইন চায়। যারা চায় না তারা হয় প্রকৃত মুসলমান নয় নতুবা ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে না কিংবা ব্যক্তিগতভাবে পাপাচার ও অপরাধে জড়িত। এদের ব্যাপারে শরীয়তের সহনশীলতা ও কল্যাণপূর্ণ নীতি বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা বাল্যবিবাহের দেশ। এ নিয়ে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র, সংস্থা ও দাতা প্রতিষ্ঠান খুবই উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগে বাংলাদেশের দায়িত্বশীলরাও ভীষণভাবে আক্রান্ত। অথচ এ বিষয়ে ৯২ ভাগ মুসলমানকে ইসলামের আলোকে পথ প্রদর্শনই সরকারের দায়িত্ব। সংবিধান, গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচার এটাই বলে। যারা এদেশকে বাল্যবিবাহের দেশ বলে হেয় করছে তাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে শতকরা ৫৬ জন মানুষ তাদের পিতৃপরিচয় জানে না। শতকরা ৩৪ জন তরুণী বিয়ের আগেই সন্তানের মা হয়। কোন কোন সমাজে শতকরা ১৪ জন পিতা নিজ ঔরসজাত কন্যার সাথে যৌন সম্পর্ক রাখে। তাদের সংসার টিকে না। এক জীবনে বহু সঙ্গী বদল হয়। তারা বিবাহ ছাড়াই একসাথে বসবাস করে। আমাদের বাংলাদেশে এ ধরনের সমস্যা নেই বললেই চলে। পিতৃপরিচয়হীন জারজ সন্তান এদেশে অত্যন্ত বিরল। দুর্ঘটনাক্রমে দুয়েকটি থাকলেও সমাজ ও ধর্ম এসবকে সবসময়ই নিরুৎসাহিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। কুমারী মাতা বিষয়টি বাংলাদেশে খুবই সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত। পিতা-কন্যার যৌন সম্পর্ক এ দেশে ধারণাও করা যায় না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ এসব অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত। বিয়ে, সংসার, সন্তান ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ যথেষ্ট রক্ষণশীল ও আদর্শ। যদিও বহু বছর ধরে পশ্চিমা দেশ ও তাদের বাংলাদেশি এজেন্টরা এদেশেও বিবাহবহির্ভূত যৌনজীবন, লিভটুগেদার, কুমারী মাতা, পিতৃপরিচয়হীন সন্তান, সমকামিতা ইত্যাদি জনপ্রিয় করার জন্য নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে বাল্যবিবাহ রোধে কঠোর ও অমানবিক আইন প্রয়োগও উপরোক্ত মিশনেরই অংশ।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন, ইভটিজিং, আত্মহত্যায় বাধ্যকরণ, ধর্ষণসহ হাজারো অপরাধ রাত-দিন সংঘটিত হচ্ছে। সংবাদ পাওয়ামাত্রই ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি, দারোগাসহ অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তারা ছুটে এসে নারীকে উদ্ধার করেছেন, অপরাধীকে পাকড়াও করে শাস্তি দিয়েছেন এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক সময় লোকমুখে অপরাধের কথা শুনেও তারা নড়েন চড়েন না। জিজ্ঞেস করলে বলেন, কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। মিডিয়া থেকে খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছেন এমন দৃষ্টান্তও বেশি নেই। আদালত নির্দেশ পাঠালে অথবা উচ্চআদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে হুকুম দিলে তবে তাদের কুম্ভকর্ণের ঘুম কিছুটা ভাঙ্গে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, একটি বিষয় বাংলাদেশে আছে যা রোধ করা বা জড়িতদের তছনছ করে দেয়ার ব্যাপারে প্রশাসন, পুলিশ, এনজিও ও তথাকথিত সমাজকর্মীরা একপায়ে খাড়া থাকেন। সেই কঠিন অপরাধটির নাম ‘বিবাহ’। তাদের ভাষায় বাল্যবিবাহ। আপনি গত তিন বছরের সংবাদপত্র ঘেঁটে দেখুন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসন, বিচার ও আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ যে অভিযানগুলো চালিয়েছেন তার শতকরা ৯৮ ভাগ হবে বিয়েবাড়িতে হানা। বাল্যবিবাহ রোধে ম্যাজিস্ট্রেট সাথে এসআই। বাল্যবিবাহ রোধে ইউএনও সাথে ওসি। বিবাহ রোধে উপজেলার কোন কর্মকর্তা সাথে এনজিও ও পুলিশ। বর গ্রেফতার, তার বাবা গ্রেফতার, কনে তাদের হেফাজতে, তার মা গ্রেফতার, বাবা ও কাজি গ্রেফতার, বিয়ের আয়োজন ল-ভ-, পালিয়ে গেছে বরত্রীরা। নতুন আইন হচ্ছে বাল্যবিবাহ দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের তিন বছরের জেল ও পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা। ১৮ বছরের একদিন আগে মেয়ে বিয়ে দিলেও বাবা-মাকে জেল খাটতে হবে। গুনতে হবে জরিমানা। কারণ মেয়েটি সরকারের আইনে নাবালিকা। কিন্তু ১৩ বছর থেকে ১৮ পর্যন্ত (নাউজুবিল্লাহ)যদি সে ছেলে বন্ধুর সাথে যৌনসম্পর্ক তৈরি করে, ১৪/১৫ বছরে গর্ভে সঞ্চারিত সন্তান নষ্ট করে কিংবা ১৬/১৭ বছরে কুমারী মাতা হয়ে সন্তান লালন করে তাহলে এ নিয়ে উল্লেখিত কর্তা-ব্যক্তিদের কোন মাথাব্যথা নেই। তাদের সব উদ্বেগ কেবল এই মেয়ের বিয়ে হলে। এখানে কম বয়সে বিয়ে ও মা হওয়ার যেসব সমস্যা হতে পারে যার ক্ষেত্রে বিয়ে না হলে আরও বেশি সমস্যা, তার বিয়ে হতে দিতে সমস্যা কোথায়? প্রধানমন্ত্রী নতুন আইনে রেখেছেন পিতা-মাতা ও আদালতের নির্দেশে ১৬ বছরেও বিয়ে হতে পারবে। এ সুযোগটি রদ করার জন্যে একশ্রেণির নারী-পুরুষ বলা যায় কোমরে গামছা বেঁধে নেমেছে। সত্যিই অবাক লাগে মানুষের বিবেকহীনতা ও দৃষ্টির সংকীর্ণতায়। পশ্চিমাদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেয়ার পরিণতি কি এতই করুণ যে, নিজ দেশের শত সাধনার অর্জন চরিত্র, সততা, পরিবারের বন্ধন, জন্মের পরিচয়, মা ও সন্তানের দৃঢ় সম্পর্ক, বিয়ে-শাদীর শান্তিময় পরিণতি, নারী-পুরুষের যৌন পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে যে কোন মূল্যে তারা বাংলাদেশকেও একটি পশুর সমাজে পরিণত করতে চান। বিবাহপূর্ব যৌনমিলন, ঘরে ঘরে ব্যভিচার, ব্যাপক জারজ সন্তান, কুমারী মাতা, সমকাম ও পিতা-কন্যার নোংরামী বাংলাদেশে আমদানি করার ইচ্ছা নিয়েই কি তারা সবকিছু বাদ দিয়ে বিশেষভাবে বাল্যবিবাহ রোধের মুখরোচক শ্লোগান তুলে মূলত বিবাহ রোধে নেমেছেন?
সমাজগবেষকদের বলব, বিগত নব্বই বছর ধরে এদেশে বাল্যবিবাহ বিরোধী আইন চালু আছে। এরপরও শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ সামাজিক বাস্তবতায় বৃটিশদের তৈরী এ অবাস্তব আইন মানতে পারেনি। শুনেছি ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ বিরোধী আইন পাশের আগে আগে এদেশে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে ফেলেছিলেন। কেননা, আইন পাশ হয়ে গেলে ছেলে ২১ মেয়ে ১৮ বছরের না হলে আর বিয়ে দেয়া যাবে না। এরপর থেকে ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ যে বয়সেই বিয়ে হোক বাধ্য হয়ে কনের বয়স লিখতে হত ১৮। এরপর বাংলাদেশের যত শিক্ষিত ব্যক্তি, বিচারপতি, সচিব ও মেধাবী পেশাজীবী অতীত হয়ে গেছেন বা বর্তমানে যাদের বয়স সত্তরের বেশি তাদের প্রত্যেকের বাবা-মার বিয়ে বৃটিশ আইন লঙ্ঘন করেই হয়েছে, যাকে নির্জলা বাল্যবিবাহ বলা চলে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম নেই তা বলব না, তবে সেসব আঙ্গুলে গোনা যাবে। সরকারদলীয় একদল আলেম প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, তার পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন তার মাতা বেগম ফজিলাতুননেসাকে বিয়ে করেন তখন তার বয়স চৌদ্দ। তৎকালীন প্রায় প্রতিটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ছেলে মেয়েদের বিয়ে তাদের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টির শুরুতেই দেয়া হত, যেন তারা প্রকৃতির এ বিধানকে শরীয়তসম্মতভাবেই পালন করতে পারে। এতে সেসব লোকের প্রশ্নের জবাবও রয়েছে যারা দাবি করে যে, ১৮ ও ২১ বছরের আগে বিয়ে হলে কিংবা বিশ-বাইশ বছরের আগে মা হলে মেয়েদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায় আর সন্তান দুর্বল ও মেধাহীন হয়। মূলত এসব একান্ত বাজে কথা। নারীদের স্বাস্থ্য বা সন্তানের কল্যাণ এখানে উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হল, উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের অবাধ যৌনতায় উৎসাহিত করে বাংলাদেশকেও পশুর রাজ্যে পরিণত করা।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ের কোন বয়স নেই। তবে পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, সংস্কৃতি, মনোদৈহিক অবস্থা, আর্থসামাজিক বাস্তবতা ইত্যাদি বিবেচনায় বিয়ের বয়স অভিভাবকরাই নির্ধারণ করবেন। কোন কারণবশত সরকার উপদেশ বা পরামর্শ দিতে পারে। যথেষ্ট নমনীয়তা বজায় রেখে বিধি-বিধানও করতে পারে। তবে বিয়ের মত একটি মৌলিক মানবিক অধিকার রোধে জেল-জরিমানা করতে পারে না। পিতৃহীন, মাতৃহীন, গৃহসম্পদহীন, আশ্রয়হীন, সামাজিক সমস্যায় নিপতিত অথবা সংস্থান ও নিরাপত্তার মুখাপেক্ষী কোন ছেলে-মেয়েকে তাদের মনোদৈহিক প্রস্তুতি সাপেক্ষে নির্ধারিত বয়সের কিছু আগে বিয়ে দেয়া আর যাই-হোক চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধ হতে পারে না। একটি বিয়ে বাড়িকে তছনছ করা, বরযাত্রীদের তাড়িয়ে দেয়া, খাদ্য-সামগ্রী উল্টে ফেলে দেয়া, বর কনেকে ভয় পাইয়ে দেয়া, বাবা-মা ও কাজি সাহেবকে গ্রেফতার করা, তিন বছর জেল খাটানো আর পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা কোন সভ্যজগতের আইন হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভা, বিশেষ করে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আইনটি সংশোধনের সময় আমাদের এ নিবন্ধটি বিবেচনায় রাখলে দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে। দেশের প্রতিটি আইন শতকার ৯২ ভাগ মানুষের ধর্মীয় অধিকারের আলোকে পুনর্বিবেচনা ও প্রয়োজনীয় সংশোধন সময়ের দাবি। আশা করি মুসলমানরা এদেশে শরীয়তের আলোকে চলার মত সুযোগ পাবে। রাষ্ট্র ও সরকার পশ্চিমাদের সব কথা অন্ধের মতো অনুসরণ করবে না। পশ্চিমাদের এজেন্টদের কথাও না। স্বাধীন দেশে সরকার স্বাধীনভাবেই সিদ্ধান্ত নেবে।
-মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী