এক লা-মাযহাবী ভাইয়ের নিম্নোক্ত লেখাটির জবাব আশা করছি।
পর্ব ১
৭৪০. সাহল ইবনু সা‘দ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকদের নির্দেশ দেয়া হত যে, সালাতে প্রত্যেক ডান হাত বাম হাতের উপর রাখবে।* আবূ হাযিম (রহ.)বলেন, সাহল (রহ.) এ হাদীসটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করতেন বলেই জানি। ইসমাঈল (রহ.) বলেন, এ হাদীসটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতেই বর্ণনা করা হতো। তবে তিনি এমন বলেননি যে, সাহল
(রহ.) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করতেন। (আধুনিক
প্রকাশনীঃ ৬৯৬, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৭০৪)
* লা-মাযহাবী ঘরনার এক প্রকাশনীর ৬৯৬ নম্বরে অত্র হাদীসরে বিষয়ে যা আলোচনা করা হয়েছে তা হুজুর সমীপে তুলে ধরলাম। এ বিষয়ে সঠিক সমাধান পেশ করবেন বলে আশা রাখি। Òসলাতে নাভির নীচে হাত বাঁধার কথা সহীহ
হাদীসে নাই। নাভির নীচে হাত বাঁধার কথা প্রমাণহীন। বরং হাত বুকের উপর
বাঁধার কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ﻋﻦ ﻭﺍﺋﻞ ﺑﻦ ﺣﺠﺮ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻗﺎﻝ
ﺻﻠﻴﺖ ﻣﻊ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻓﻮﺿﻊ ﻳﺪﻩ ﺍﻟﻴﻤﻨﻰ ﻋﻠﻰ ﻳﺪﻩ ﺍﻟﻴﺴﺮﻯ ﻋﻠﻰ
ﺻﺪﺭﻩ ﺭﻭﺍﻩ ﺍﺑﻦ ﺧﺰﻳﻤﺔ ﻓﻲ ﺻﺤﻴﺤﺔ
ওয়ায়িল বিন হুজর (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি
বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সলাত আদায়
করেছি। তিনি তার বুকে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতেন।
পর্ব ২
বুখারীর হাদীসের আরবী ইবারতে ﺫﺭﺍﻋﻪ শব্দের অর্থ করেছেন হাতের কব্জি। কিন্তু এমন কোন অভিধান নেই যেখানে ﺫﺭﺍﻉ অর্থ কব্জি করা হয়েছে। আরবী অভিধানগুলোতে ﺫﺭﺍﻉ
শব্দের অর্থ পূর্ণ একগজ বিশিষ্ট হাত। অনুবাদক শুধুমাত্র সহীহ হাদীসকে
ধামাচাপা দিয়ে মাযহাবী মতকে অগ্রাধিকার দেয়ার উদ্দেশে ইচ্ছাকৃতভাবে
অনুবাদে পূর্ণ হাতের পরিবর্তে কব্জি উল্লেখ করেছেন। তথাপিও সংশয় নিরসনের
লক্ষে এ সম্পর্কে খানিকটা বিশদ আলোচনা উদ্ধৃত করা হলো- ওয়াইল বিন হুজ্র
(রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, আমি নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সলাত আদায় করেছি। (আমি দেখেছি) নাবী সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর রাখলেন।
(বুখারী ১০২ পৃষ্ঠ। সহীহ ইবনু খুযায়মাহ ২০পৃষ্ঠা। মুসলিম ১৭৩ পৃষ্ঠা।
আবূ দাঊদ ১ম খণ্ড ১১০, ১২১, ১২৮ পৃষ্ঠা। তিরমিযী ৫৯ পৃষ্ঠা। নাসাঈ ১৪১
পৃষ্ঠা। ইবনু মাজাহ ৫৮, ৫৯ পৃষ্ঠা, মেশকাত ৭৫ পৃষ্ঠা। মুয়াত্তা মালিক ১৭৪
পৃষ্ঠা। মুয়াত্তা মুহাম্মাদ ১৬০ পৃষ্ঠা। যাদুল মায়াদ ১২৯ পৃষ্ঠা। হিদায়া
দিরায়াহ ১০১ পৃষ্ঠা। কিমিয়ায়ে সাআদাত ১ম খণ্ড ১৮৯ পৃষ্ঠা। বুখারী আযীযুল
হক ১ম খণ্ড হাদীস নং ৪৩৫। বুখারী আধুনিক প্রকাশনী ১ম খণ্ড হাদীস নং ৬৯৬।
বুখারী ইসলামিক ফাউণ্ডেশন ২য় খণ্ড হাদীস নং ৭০২; মুসলিম ইসলামিক
ফাউণ্ডেশন ২য় খণ্ড হাদীস নং ৮৫১। আবূদাঊদ ইসলামিক ফাউণ্ডেশন ১ম খণ্ড
হাদীস নং ৭৫৯, তিরমিযী ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১ম খণ্ড হাদীস নং ২৫২, মেশকাত
নূর মোহাম্মদ আযমী ২য় খণ্ড ও মাদ্রাসা পাঠ্য ২য় খণ্ড হাদীস নং ৭৪১, ৭৪২।
বুলুগুল মারাম বাংলা ৮২ পৃষ্ঠা)
পর্ব ৩
বুকের উপর হাত বাঁধা সম্বন্ধে একটি হাদীস বর্ণিত হল- সীনা বা বুকের উপর
এরূপভাবে হাত বাঁধতে হবে যেন ডান হাত উপরে এবং বাম হাত নীচে থাকে।
(মুসলিম, আহমাদ ও ইবনু খুযাইমাহ) হাত বাঁধার দু’টি নিয়ম- প্রথম নিয়ম- ডান
হাতের কব্জি বাম হাতের কব্জির জোড়ের উপর থাকবে। (ইবনু খুযাইমাহ) দ্বিতীয়
নিয়ম- ডান হাতের আঙ্গুলগুলি বাম হাতের কনুই-এর উপর থাকবে, অর্থাৎ সমস্ত
ডান হাত বাম হাতের উপর থাকবে। (বুখারী) এটাই যিরা‘আহর উপর যিরা‘আহ রাখার পদ্ধতি।
পর্ব ৪
বুকে হাত বাঁধা সম্পর্কে আলোচনা- বুকে হাত বাঁধা সম্বন্ধে
আল্লামা হায়াত সিন্ধী একখানা আরবী রিসালা লিখে তাতে তিনি প্রমাণিত করেছেন
যে, সলাতে সীনার উপর হাত বাঁধতে হবে। তাঁর পুস্তিকার নাম “ফতহুল গফূর ফী তাহকীকে ওযয়িল ইয়াদায়নে আলাস সদূর”। পুস্তিকা খানা ৮ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত। তা হতে কয়েকটি দলীল উদ্ধৃত করছি।
১। ইমাম আহমাদ স্বীয় মসনদে কবীসহা বিন হোল্ব তিনি স্বীয় পিতা (হোলব) হতে রিওয়ায়াত করেছেন যে, তিনি (হোলব) বলেনযে, আমি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে (সলাত হতে ফারেগ
হতে মুসল্লীদের দিকে) ডান ও বাম দিকে ফিরতে দেখেছি, আর দেখেছি তাঁকে স্বীয় সীনার উপর হাত বাঁধতে। উক্ত হাদীসে ‘ইয়াহইয়া’ নামক রাবী স্বীয় দক্ষিণ হস্ত বাম হস্তের কব্জির উপর রেখে দেখালেন। আল্লামা হায়াত সিন্ধী বলেন যে, আমি ‘তাহকীক’ কিতাবে ﻳﻀﻊ ﻳﺪﺍﻩ ﻋﻠﻰ ﺻﺪﺭﻩ তিনি স্বীয় সীনার উপর হাত রাখলেন, এ কথা দেখেছি। আর আমরা বলছি যে, হাফিয আবূ উমর ইবনু আবদুল বর স্বীয় “আল ইসতিআব ফী মাআরিফাতিল আসহাব” কিতাবে উক্ত হাদীস ‘হোলব’ সহাবী হতে তাঁর পুত্র কবীসা রিওয়ায়াত করেছেন এ কথা উল্লেখ করে উক্ত হাদীস সহীহ
বলেছেন। (২য় খণ্ড, ৬০০ পৃঃ)
২।
ইমাম আবূ দাঊদ তাউস (তাবিঈ) হতে সীনার উপর হাত বাঁধার হাদীস রিওয়ায়াত
করেছেন।
৩।
ইমাম ইবনু ‘আবদুল বর “আত্ তামহীদ লিমা ফীল মুয়াত্তা মিনাল
মাআনী ওয়াল আসানীদ” কিতাবে উক্ত ‘তাউস’ তাবি‘ঈর হাদীস উল্লেখ করে সীনার
উপর হাত বাঁধার কথা বলেছেন। এতদ্ব্যতীত ওয়ায়েল বিন হুজর হতেও সীনার উপর হাত বাঁধার হাদীস উল্লেখ করেছেন।
৪।
ইমাম বাইহাকী ‘আলী “ফাসল্লি লিরব্বিকা ওয়ান্হার”, এর অর্থ এরূপ বর্ণনা করেছেন- তুমি নামায পড়ার সময় ডান
হাত বাম হাতের উপর রাখ। (জওহারুন্ নকীসহ সুনানে কুবরা ২৪-৩২ পৃঃ)
৫।
ইমাম বুখারী স্বীয় ‘তারীখে’ ‘উকবাহ বিন সহবান, তিনি (‘উকবাহ) ‘আলী (রাযি.) হতে রিওয়ায়াত করেছেন যে, ‘আলী (রাযি.) বাম হাতের উপর ডান হাত রেখে (হস্তদ্বয়)সীনার উপর বেঁধে “ফাসল্লি লি রব্বিকা ওয়ান্হার” (আয়াতের) অর্থ বুঝালেন।
অর্থাৎ উক্ত আয়াতের অর্থ ‘তুমি সীনার উপর হাত বেঁধে সলাতে যাও’। এর বাস্তব রূপ তিনি [‘আলী (রাযি.)] সীনার উপর হাত বেঁধে দেখালেন। উক্ত আয়াতের অর্থ ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আব্বাস (রাযি.) হতেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।
এখন নাভির নীচে হাত বাঁধার কোন হাদীস আছে কিনা তা-ই দেখা যাক। নাভির নীচে হাত বাঁধা ঃ ইমাম বাইহাকী ‘আলী হতে নাভির নীচে হাত বাঁধার একটি হাদীস উল্লেখ করে তাকে যঈফ বলেছেন।
পর্ব-৫
নাভির নীচে হাত বাঁধার কোন সহীহ হাদীস নাই- আল্লামা সিন্ধী হানাফী
বিদ্বানগণের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, যদি তুমি বল যে, ইবনু আবী শায়বার ‘মুসান্নাফ’ (হাদীসের কিতাবের নাম) হতে শায়খ কাসিম বিন কাতলুবাগা ‘তাখরীজু আহাদিসিল এখতিয়ার’ কিতাবে ‘ওকী’ মুসা বিন ওমায়রাহ হতে, মূসা আলকামা বিন ওয়ায়িল বিন হুজর হতে যে রিওয়ায়াত করেছেন তাতে ‘নাভির নীচে’হাত বাঁধার কথা উল্লেখ আছে। তবে আমি (আল্লামা সিন্ধী) বলি যে, ‘নাভির নীচে’ হাত বাঁধার হাদীস ভুল। ‘মুসান্নাফ’ এর সহীহ গ্রন্থে উক্ত সনদের উল্লেখ আছে। কিন্তু ‘নাভির নীচে’ এই শব্দের উল্লেখ নাই।
পর্ব ৬
উক্ত হাদীসের পরে (ইবরাহীম) ‘নখয়ী’ এর আসার (সহাবা ও তাবিঈদের উক্তি ও আচরণকে ‘আসার’ বলে)উল্লেখ আছে। উক্ত ‘আসার’ ও হাদীসের শব্দ প্রায় নিকটবর্তী। উক্ত ‘আসার’-এর শেষ ভাগে ‘ফিস্সলাতে তাহ্তাস সুররাহ’ অর্থাৎ নামাযের মধ্যে নাভির নীচে (হাত বাঁধার উল্লেখ আছে)। মনে হয় লেখকের লক্ষ্য এক লাইন হতে অন্য লাইনে
চলে যাওয়ায় ‘মওকুফ’ (হাদীসকে) ‘মরফু’ লিখে দিয়েছেন। (যে হাদীসের
সম্বন্ধÑসহাবার সাথে হয় তাকে ‘মওকুফ’ আর যার সম্বন্ধ রসূলুল্লাহ
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে হয় তাকে ‘মরফু’ হাদীস বলে)। আর আমি যা কিছু বললাম আমার কথা হতে এটাই প্রকাশ পায় যে, ‘মুসান্নাফ’ এর সব খণ্ড মিলিতভাবে নাভির নীচে হাত বাঁধা বিষয়ে এক নয় অর্থাৎ সবগুলোতে নাভির নীচে হাত বাঁধার কথাটি উল্লেখ নাই। তাছাড়া বহু আহলে হাদীস (মুহাদ্দিস) উক্ত হাদীস রিওয়ায়াত করেছেন। অথচ ‘নাভির নীচে’ এর কথা কেউই উল্লেখ করেননি। আর আমি তাঁদের মধ্যেকার কোন ব্যক্তি হতে শুনিওনি। কেবল ‘কাসেম বিন কাতলুবাগা ঐ কথার (নাভির নীচে) উল্লেখ করেছেন। তিনি ‘তাম্হীদ’ কিতাবের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন যে, (আহলে হাদীসদের মধ্যে প্রথম) ইবনু
আব্দিল বর উক্ত কিতাবে বলেছেন যে, সওরী ও আবূ হানীফা নাভির নীচের কথা বলেন। আর সেটা ‘আলী ও ইব্রাহীম নখঈ হতে বর্ণিত হয়ে থাকে বটে, কিন্তু ঐ দু’জন (‘আলী ও নখঈ) হতে সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। যদি সেটা হাদীস হতো তাহলে ইবনু ‘আবদুল বর ‘মুসান্নাফ’ হতে ওটা অবশ্য উল্লেখ করতেন। কেননা হাত বাঁধা সম্বন্ধে ইবনু আবী শায়বা হতে তিনি বহু রিওয়ায়াত এনেছেন। ২য় ইবনু হজর আসকালানী, (আহলে হাদীস) ৩য় মুজ্দুদ্দীন ফিরোজাবাদী, (আহলে হাদীস)
৪র্থ আল্লামা সৈয়ূতী, (আহলে হাদীস) ৫ম আল্লামা যায়লয়ী, (মুহাককিক) ৬ষ্ঠ
আল্লামা আয়নী (আহলে তাহ্কীক) ও ৭ম ইবনু আমীরিল হাজ্জ (আহলে হাদীস)
প্রভৃতির উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন যে, যদি “নাভির নীচে”-এর কথা থাকত তাহলে সকলেই তা উল্লেখ করতেন। কেননা তাঁদের সকলের কিতাব ইবনু আবী শায়বার বর্ণিত হাদীস দ্বারা পূর্ণ। তিনি এ সম্পর্কিত হাদীসদ্বয়ের আলোচনা করে বুকে হাত বাঁধাকে ওয়াজিব বলেছেন।
পর্ব ৭
সিন্ধী সাহেব উপসংহারে লিখেছেন “জেনে রাখ যে, ‘নাভির নীচে’-এ কথা প্রমাণের দিক দিয়ে না ‘কত্য়ী’ (অকাট্য), না ‘যন্নী’ (বলিষ্ঠ ধারণামূলক)। বরং প্রমাণের দিক দিয়ে ‘মওহূম’ (কল্পনা প্রসূত) আর যা মওহূম তদ্দ্বারা শরীয়তের হুকুম প্রমাণিত হয় না।…….
কাজেই শুধু শুধু কল্পনা করে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর
দিকে কোন বস্তুর সম্বন্ধ করা জায়েয নয়। অর্থাৎ শুধু কল্পনার উপর নির্ভর করে নাভির নীচে হাত রাখার নিয়মকে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সম্পর্কিত করা জায়েয নয়। যখন উপরিউক্ত আলোচনা হতে স্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে গেল যে, নামাযের মধ্যে সীনার উপর হাত বাঁধা নয় যে, ওটা হতে মুখ ফিরিয়ে নেন। আর ঐ বস্তু হতে কিরূপ মুখ ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব যা রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, আমি যা এনেছি (অর্থাৎ আল্লাহর ব্যবস্থা), যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে কেউ তার প্রবৃত্তিকে তার অনুগামী না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না। অতএব, প্রত্যেক মুসলমান (স্ত্রী- পুরুষের) উচিত তার উপর আমল করা, আর কখনো কখনো এই দু‘আ করা প্রভু হে, যে বিষয়ে মতভেদ করা হয়েছে তাতে আমাদেরকে সত্য পথের সন্ধান দাও। কেননা তুমিই তো যাকে ইচ্ছা ‘সিরাতে মুস্তাকীমের’ পথ দেখিয়ে থাক”। (উক্ত কিতাব ২-৮ পৃঃ ও ইবকারুল মিনান ৯৭-১১৫ পৃঃ)
পর্ব ৭
আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী তাঁর সিফাত গ্রন্থে হাত বাঁধা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে
শিরোনাম এসেছেন ঃ ﻭﺿﻌﻬﻤﺎ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺼﺪﺭ বুকের উপর দু’ হাত রাখা। অতঃপর তিনি
হাদীস উল্লেখ করে নিচে টীকা লিখেছেন। যা বন্ধনীর মধ্যে দেখানো হলো। “নাবী
ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাম হাতের পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর ডান
হাত রাখতেন।” [(আবূ দাউদ, নাসাঈ, ১/৪/২ ছহীহ সনদে, আর ইবনু হিব্বানও ছহীহ
আখ্যা দিয়েছেন। ৪৮৫] “এ বিষয়ে স্বীয় ছাহাবাগণকেও আদেশ প্রদান
করেছেন।”(মালিক, বুখারী ও আবূ আওয়ানাহ) তিনি কখনো ডান হাত দ্বারা বাম হাত
আঁকড়ে ধরতেন।” (নাসাঈ, দারাকুত্বনী, ছহীহ সনদ সহকারে। এ হাদীছ প্রমাণ
করছে যে, হাত বাঁধা সুন্নাত। আর প্রথম হাদীছ প্রমাণ করছে যে, হাত রাখা
সুন্নাত। অতএব উভয়টাই সুন্নাত। কিন্তু হাত বাঁধা ও হাত রাখার মধ্যে সমন¦য়
বিধান করতে গিয়ে পরবর্তী হানাফী ‘আলিমগণ যে পদ্ধতি পছন্দ করেছেন তা হচ্ছে
বিদআত; যার রূপ তারা এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ডান হাতকে বাম হাতের উপর
কনিষ্ঠ ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা আঁকড়ে ধরবে এবং অপর তিন অঙ্গুলি বিছিয়ে
রাখবে (ইবনু আবিদীন কর্তৃক দুররে মুখতারের টীকা (১/৪৫৪)। অতএব হে পাঠক! পরবর্তীদের (মনগড়া) এ কথা যেন আপনাকে ধোঁকায় না ফেলে। “তিনি হস্তদ্বয়কে বুকের উপর রাখতেন।” [আবু দাউদ, ইবনু খুযাইমাহ স্বীয় ছহীহ গ্রন্থে
(১/৫৪/২) আহমাদ, আবুশ্ শাইখ স্বীয় “তারীখু আছবাহান” গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ১২৫)
ইমাম তিরমিযীর একটি সানাদকে হাসান বলেছেন।
গভীরভাবে চিন্তা করলে এর বক্তব্য মুওয়াত্বা ইমাম মালিক এবং বুখারীতে পাওয়া যাবে। এ হাদীছের বিভিন্ন বর্ণনাসূত্র নিয়ে আমি ﺃﺣﻜﺎﻡ ﺍﻟﺠﻨﺎﺋﺰ কিতাবের (১১৮) পৃষ্ঠায়
বিস্তারিত আলোচনা করেছি। জ্ঞাতব্য: বুকের উপর হাত রাখাটাই ছহীহ হাদীছ
দ্বারা সাব্যস্ত। এছাড়া অন্য কোথাও রাখার হাদীছ হয় দুর্বল আর না হয়
ভিত্তিহীন। এই সুন্নাতের উপর ইমাম ইসহাক বিন রাহভিয়া ‘আমাল করেছেন।
মারওয়াযী ﺍﻟﻤﺴﺎﺋﻞ গ্রন্থে ২২২ পৃষ্ঠাতে বলেন, ইসহাক আমাদেরকে নিয়ে
বিত্রের ছলাত পড়তেন এবং তিনি কুনূতে হাত উঠাতেন আর রুকু‘র পূর্বে কুনূত
পড়তেন। তিনি বক্ষদেশের উপরে বা নীচে হাত রাখতেন। কাযী ‘ইয়াযওﺍﻹﻋﻼﻡ
কিতাবের ১৫ পৃষ্ঠায় (রিবাত্ব তৃতীয় সংস্করণ) এ ﻣﺴﺘﺤﺒﺎﺕ ﺍﻟﺼﻼﺓ ছলাতের
মুস্তাহাব কাজ বর্ণনার ক্ষেত্রে অনুরূপ কথা বলেছেন, ডান হাতকে বাম হাতের
পৃষ্ঠের উপর বুকে রাখা। ‘আবদুল্লাহ ইবনু আহমাদের বক্তব্যও এর কাছাকাছি,
তিনি তার ﺍﻟﻤﺴﺎﺋﻞ এর ৬২ পৃষ্ঠায় বলেন ঃ আমার পিতাকে দেখেছি যখন তিনি ছলাত
পড়তেন তখন তার এক হাতকে অপর হাতের উপর নাভির উপরস্থলে রাখতেন দেখুন
ﺇﺭﻭﺍﺀ ﺍﻟﻐﻠﻴﻞ (৩৫৩)।] (দেখুন নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী কৃত সিফাতু সলাতুন্নাবী
সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
পর্ব-১
সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগ থেকে হাত বাঁধার দুটো নিয়ম চলে আসছে : বুকের নীচে হাত বাঁধা ও নাভীর নীচে হাত বাঁধা। মুসলিম উম্মাহর বিখ্যাত মুজতাহিদ ইমামগণও এ দুটো নিয়ম গ্রহণ করেছেন।
নিকট অতীতে হাত বাঁধার নতুন কিছু নিয়ম আবিষ্কৃত হয়েছে, যা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে ছিল না এবং কুরআন-সুন্নাহর প্রাজ্ঞ মনীষী ও মুজতাহিদগণের সিদ্ধান্তেও তা পাওয়া যায় না। বলাবাহুল্য, এসব নিয়ম ‘শুযুয’ ও বিচ্ছিন্নতা বলে গণ্য, যা দ্বীন ও শরীয়তের বিষয়ে সম্পূর্ণ বর্জনীয়।
মোটকথা, সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে বুকের উপর হাত বাঁধার নিয়ম পাওয়া যায় না। কোনো সহীহ মরফূ হাদীসেও এই নিয়ত বর্ণিত হয়নি। মুসলিমউম্মাহর কোনো মুজতাহিদ ইমাম থেকেও নিখুঁত ও অগ্রগণ্য বর্ণনায় এই নিয়ম পাওয়া যায় না। কিছু শায ও মুনকার রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, যেগুলো হাদীস হিসেবে প্রমাণিত নয়। তেমনি কোনো কোনো মুজতাহিদ ইমাম থেকে পরবর্তীদের অসতর্ক কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়, যেগুলো ঐ ইমামের বিশিষ্ট শাগরিদ ও মনীষীদের বর্ণনার বিরোধী।
এ ধরনের একটি মতকে সুন্নাহ ও একমাত্র সুন্নাহ মনে করা যে মারাত্মক বিভ্রান্তি তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সংক্ষিপ্ত এ ভূমিকার পর এবার মূল প্রশ্নে আসা যাক।
প্রশ্নে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সলাতে নাভির নীচে হাত বাঁধার কথা সহীহ
হাদীসে নাই। নাভির নীচে হাত বাঁধার কথা প্রমাণহীন। বরং হাত বুকের উপর বাঁধার কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
প্রশ্নে বর্ণিত এ দাবী যে অন্তসারশূণ্য ও একেবারে প্রমাণবিহীন কথা এবং এ বক্তব্যে যে সত্যের লেশমাত্র নেই তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
নাভীর নীচে হাত বাঁধার সহীহ হাদীস
হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণিত, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর নাভীর নীচে রেখেছেন। সনদসহ রেওয়ায়েতের আরবী পাঠ এই-
حدثنا وكيع، عن موسى بن عمير، عن علقمة بن وائل بن حجر، عن أبيه قال : رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة.
-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৫১
এই বর্ণনার সনদ সহীহ। ইমাম কাসেম ইবনে কুতলূবুগা রাহ. (৮৭৯ হি.) বলেন- وهذا اسناد جيد
এটি একটি উত্তম সনদ।-আততা’রীফু ওয়াল ইখবার রিতাখরীজি আহাদীছিল ইখতিয়ার-হাশিয়া শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা
বুকের উপর হাত বাঁধার কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়:
প্রশ্নে সহীহ ইবনে খুযায়মার উদ্ধিৃতিতে যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে তার মান ও পর্যায় নিয়ে নিম্নে আলোকপাত করা হলো-
মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইলের রেওয়ায়েত
তাঁর বিবরণ অনুযায়ী সুফিয়ান ছাওরী রাহ., আসেম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে নামায পড়লাম … তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর বুকের উপর রাখলেন।
সনদসহ রেওয়ায়েতটির আরবী পাঠ এই-
أخبرنا أبو طاهر، نا أبو بكر، نا أبو موسى، نا مؤمل، نا سفيان، عن عاصم بن كليب، عن أبيه، عن وائل بن حجر قال : صليت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم، ووضع يده اليمنى على يده اليسرى على صدره.
-সহীহ ইবনে খুযায়মা ১/২৭২, হাদীস : ৪৭৯
মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইলের পূর্ণ বিবরণ সঠিক নয়। হাদীস শাস্ত্রের নীতি অনুসারে এ বর্ণনায় على صدره ‘বুকের উপর’ কথাটা ‘মুনকার’। অর্থাৎ সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর বর্ণনায় তা ছিল না। মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইল ভুলক্রমে তা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কারণ সুফিয়ান ছাওরী রাহ. থেকে এই হাদীস মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ ফিরয়াবী ও আবদুল্লাহ ইবনুল ওয়ালীদ রাহ.ও বর্ণনা করেছেন।
তাঁরা দু’জনই ছিকা ও শক্তিশালী রাবী। তাঁদের রেওয়ায়েতে على صدره ‘বুকের উপর’ কথাটা নেই। দেখুন : মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৮; আলমুজামুল কাবীর তবারানী ২২/৩৩
রেওয়ায়েত দুটির সনদসহ আরবী পাঠ নিম্নরূপ :
قال الإمام أحمد : حدثنا عبد الله بن الوليد، حدثني سفيان، عن عاصم بن كليب عن أبيه عن وائل بن حجر قال : … ورأيته ممسكا بيمينه على شماله في الصلاة …
وقال الإمام الطبراني : حدثنا عبد الله بن محمد بن سعيد بن أبي مريم ثنا محمد بن يوسف الفريابي ثنا سفيان عن عاصم بن كليب عن أبيه عن وائل بن حجر قال : رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يضع يده اليمنى على اليسرى وإذا جلس افترش رجله اليسرى …
এটা শুধু পাওয়া যায় মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইল রাহ.-এর বর্ণনায়, যাঁর সম্পর্কে জারহ-তাদীলের ইমামদের সিদ্ধান্ত এই যে, তিনি সাধারণভাবে বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী হলেও রেওয়ায়েতের ক্ষেত্রে তাঁর প্রচুর ভুল হয়েছে। এমনকি ইমাম বুখারী রাহ. তাকে ‘মুনকাররুল হাদীস’ বলেছেন।ইমামগণের মন্তব্য নীচে উল্লেখ করা হল-
قال البخاري : منكر الحديث، وقال أبو حاتم الرازي : صدوق شديد في السنة كثير الخطأ، يكتب حديثه، وقال أبو زرعة الرازي : في حديثه خطأ كثير، وقال ابن سعد : ثقة كثير الغلط، وقال الساجي : صدوق، كثير الخطأ وله أوهام يطول ذكرها. وقال الدارقطني : ثقة كثير الخطأ.
দেখুন : তাহযীবুল কামাল ১৮/৫২৬; তাযীবুত তাহযীব ১০/৩৪০; মীযানুল ইতিদাল ৮৯৪৯; আলমুগনী ফী যুআফা ৬৫৪৭
শায়খ আলবানীও সিলসিলাতুয যয়ীফার অনেক জায়গায় তাঁকে জয়ীফ বলেছেন এবং তাঁর সম্পর্কে ইমামগণের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন।
দেখুন : সিলসিলাতুয যয়ীফা ১/১৩১; ২/২৪৬, ৩/১৭৯; ৩/২২৭; ৪/৪৫৫ ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত : সুফিয়ান ছাওরী রাহ. ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর বিবরণ বর্ণনা করেছেন আসিম ইবনে কুলাইব থেকে। আসিম ইবনে কুলাইব থেকে এই হাদীস আরো বর্ণনা করেছেন :
১. শোবা ইবনুল হাজ্জাজ,
২. বিশর ইবনুল মুফাদ্দাল
৩. কায়স ইবনুর রাবী
৪. যাইদা ইবনে কুদামা
৫. আবদুল ওয়াহিদ ইবনে যিয়াদ
৬. খালিদ ইবনু আবদিল্লাহ
৭.আবু ইসহাক
৮. আবুল আহওয়াস
৯. আবদুল্লাহ ইবনে ইদরীস,
১০. মুসা ইবনে আবী আয়েশা
১১. আবু আওয়ানা প্রমুখ হাদীসের বিখ্যাত ইমাম ও ছিকা রাবীগণ। তাঁরা সকলে আসিম ইবনে কুলাইব থেকে নামাযে হাত বাঁধার হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কেউ على صدره ‘বুকের উপর’ কথাটা বর্ণনা করেননি।
এঁদের রেওয়ায়েতগুলোর জন্য দেখুন যথাক্রমে : (১. মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৯, হাদীস : ১৮৮৭৮
২. সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৭২৬; সুনানে নাসায়ী, কুবরা, হাদীস : ১১৮৯; মুজতাবা, হাদীস : ১২৬৫; মুসনাদে বাযযার-আলবাহরুয যাখখার, হাদীস : ৪৪৮৫; আলমু’জামুল কাবীর তবারানী ২২/৩৭
৩. আলমুজামুল কাবীর, তবারানী ২২/৩৩
৪. মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৮; আলমুজামুল কাবীর ২২/৩৫
৫. মুসনাদে আহমদ ৪/৩১৬
৬. সুনানে কুবরা বায়হাকী ২/১৩১
৭. আলমুজামুল আওসাত তবারানী ২/৪২৩
৮. মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালিসী ২/৩৫৮, হাদীস : ১১১৩; আলমুজামুল কাবীর তাবারানী ২২/৩৪
৯. সহীহ ইবনে হিববান ৫/২৭১; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৩/৩১৭
১০. মুসনাদে বাযযার আলবাহরুয যাখখার, হাদীস : ৪৪৮৯
১১. মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার বায়হাকী ৩/৫০)
এ থেকে বোঝা যায়, আসিম ইবনে কুলাইব বুকের উপর হাত বাঁধার কথা বর্ণনা করেননি। তাহলে সুফিয়ান ছাওরীর সঠিক বর্ণনায় তা কীভাবে থাকতে পারে?
তো এই সকল ইমাম ও ছিকা রাবীর বর্ণনার সাথে তুলনা করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, এ হাদীসে على صدره অংশটা মুনকার তথা অগ্রহণযোগ্য।
উল্লেখ্য, কুলাইব ইবনে শিহাব ছাড়া অন্যদের সূত্রেও ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর এই হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো সহীহ সনদে على صدره ‘বুকের উপর’ কথাটা পাওয়া যায় না।
দেখুন : বুগয়াতুল আলমায়ী ফী তাখরীজিয যায়লায়ী, নসবুর রায়াহর হাশিয়ায় ১/৩১৬
সহীহ ইবনে খুযায়মার উক্ত রেওয়ায়েত সম্পর্কে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর একটি প্রাজ্ঞচিত বক্তব্য উদ্ধৃত করে শেষ করছি। তিনি বলেন-
والحاصل أن رواية وائل رواها غيرُ واحدٍ، ولم يَرْوِها أحدٌ على لفظ ابن خُزَيْمَة، وإنما زادها راوٍ بعد مرور الزمان، فهو ساقطٌ قطعًا، فلا يجمد عليها مع فقدان العمل به.
মোটকথা ওয়ায়েল (ইবনে হুযর রা.) এর রেওয়ায়েতটি অনেকেই বর্ণনা করেছেন । কিন্তু কেউ-ই ইবনে খুযায়মার শব্দে বর্ণনা করেন নি। বরং অনেক পরে এসে কোন রাবী তাতে সংযোজন ঘটিয়েছেন। অতএব সুনিশ্চিতভাবেই তা হাদীস থেকে বিয়োজিত অংশ। অতএব যেহেত ু(বুকের উপর হাত বাধার বিষয়ে সাহবী, তাবেয়ী, তাবে তাবয়েীন ও উম্মাহর অনুসৃত ইমামদের) কারো আমল বিদ্যমান নেই তাই এর উপর স্থবির হওয়া যাবে না। (ফয়জুল বারী)
সহীহ ইবনে খুযায়মা সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারনার নিরসন:
অনেকে মনে করে থাকেন সহীহ ইবনে খুযায়মায় উল্লেখিত সকল হাদীসই বুঝি সহীহ। কিন্তু ব্যাপারটি এরকম নয় । বরং এ কিতাবে যয়ীফ হাদীসও রয়েছে। যদিও তা সংখ্যায় কম। আবার ক্বচিত ক্বদাচিত মারাতœক দুর্বল বর্ণনাও চলে এসেছে। স্বয়ং এ কিতাবের মুহাক্কিক মুস্তফা আ‘যমী সাহেব তার মুকাদ্দিমাতুল মুহাক্কিকেও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন-
أقول: إن صحيح ابن خزيمة ليس ك الصحيحين بحيث يمكن القول إن كل ما فيه هو صحيح، بل فيه ما هو دون درجة الصحيح، وليس مشتملا على الأحاديث الصحيحة والحسنة فحسب، بل يشتمل على احاديث ضعيفة أيضا إلا أن نسبتها ضئيلة جدا، إذا قورنت بالأحاديث الصحيحة والحسنة، وتكاد لا توجد الأحاديث الواهية أو التى فيها ضعف شديد إلا نادرا كما يتبين بمراجعة التعليقات
(সহীহ ইবনে খুযায়মার মুকাদ্দিমাতুল মুহাক্কিক পৃ.২৭.)
পর্ব-২
শুধু অভিধান দেখে হাদীসের মর্মার্থ নির্ণয় করা গোমরাহীর কারণ
প্রশ্নের বিবরণ অনুযায়ী যিরা এর যে মস্তিস্ক প্রসূত ও অভিধান নির্ভর অর্থ করা হয়েছে তা বড়ই আশ্চর্যজনক। লেখকের প-িত্যপূর্ণ ? তাহকীক দেখে মনে পড়ছে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. এর দাদা উস্তাদ সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ রহ. এর কথা। তিনি কত সুন্দর কথাই না বলেছেন للفقهاء إلا مضلة الحديث অর্থাৎ ফকীহগণ ব্যতীত অন্যদের জন্য হাদীস শরীফ বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাড়ায়। (ইবনুল হাজ্জ মালেকী, আল মাদখাল,১/১২৮)
বুখারী শরীফে হযরত সাহল বিন সাদ রা. বর্ণিত হাদীসে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তাহলো উক্ত হাদীসে ডান হাত বাম হাতের বাহুর উপর রাখতে বলা হয়েছে। ডান হাতের বাহু বাম হাতের বাহুর উপর রাখতে বলা হয় নি।
উল্লেখিত হাদীসে যিরা এর সঠিক ব্যাখ্যা-
১. আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. এর ব্যাখ্যা:
উক্ত হাদীসের যিরা শব্দের ব্যাখ্যায় বিশ্ব বরেণ্য হাদীস বিশারদ আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন-
أبهم موضعه من الذراع وفي حديث وائل عند أبي داود والنسائي ثم وضع يده اليمنى على ظهر كفه اليسرى والرسغ والساعد وصححه بن خزيمة وغيره

অর্থাৎ বাহুর কোন জায়গায় রাখতেন সেটা এই হাদীসে অস্পষ্ট। আবু দাউদ ও নাসাঈ বর্ণিত ওয়াইল রা. এর হাদীসে বলা হয়েছে : অত:পর তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও বাহুর উপর রাখলেন। ইবনে খুযায়মা রহ. প্রমুখ এটিকে সহীহ বলেছেন। (ফতহুল বারী ২/২৭৫)
২.আল্লামা শাওকানী এর ব্যাখ্যা:
আল্লামা শাওকানী (১২৫৫ হি.) ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর হাদীসের ব্যাখ্যাq বলেন, ‘হাদীসের অর্থ এই যে, ডান হাত বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর উপর রাখবে। তবারানীর রেওয়ায়েতে আছে, (আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাযে তাঁর ডান হাত রাখলেন বাম হাতের পিঠের উপর কব্জির কাছে। (ইমাম) শাফেয়ী রাহ.-এর শাগরিদরা বলেছেন, ডান হাতের পাতা দ্বারা বাম হাতের পাতার গোড়া, কব্জি ও বাহুর কিছু অংশ পেঁচিয়ে ধরবে। হাদীসটি হাতের পাতা হাতের পাতার উপর রাখার বৈধতা প্রমাণ করে। এটিই অধিকাংশ মনীষীর গৃহীত নিয়ম। …’ এরপর তিনি নামাযে হাত ছেড়ে রাখার প্রসঙ্গ আলোচনা করেন।
তার আলোচনার আরবী পাঠ এই-
والمراد أنه وضع يده اليمنى على كف يده اليسرى ورسغها وساعدها. ولفظ الطبراني : وضع يده اليمنى على ظهر اليسرى في الصلاة قريبا من الرسغ، قال أصحاب الشافعي : يقبض بكفه اليمنى كوع اليسرى وبعض رسغها وساعدها.
والحديث يدل على مشروعية وضع الكف على الكف، وإليه ذهب الجمهور …
-নায়লুল আওতার ২/১৮১
এরপর হযরত সাহল ইবনে সাদ রা. থেকে বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে বলেন,‘যিরার কোন অংশে ডান হাত রাখা হবে তা এ হাদীসে অস্পষ্ট। তবে আহমদ ও আবু দাউদের রেওয়ায়েতে (যাইদা ইবনে কুদামার সূত্রে ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর হাদীস) যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তা পরিষ্কারভাবে পাওয়া যায়।
قوله على ذراعه اليسرى أبهم هنا موضعه من الذراع، وقد بينته رواية أحمد وأبي داود في الحديث الذي قبله
-প্রাগুক্ত ২/১৮৯
সুতরাং শাওকানী রাহ.-এর মতেও সাহল ইবনে সাদ রা.-এর হাদীসের অর্থ হাতের পাতা হাতের পাতার উপর রাখা, তবে এমনভাবে, যেন তা যিরার কিছু অংশের উপর থাকে।
পাঠক এবার নিজেই বিচার করে দেখুন-সহীহ হাদীসের মর্মার্থকে ধামাচাপা দিয়ে কারা মাযহাবী মতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন ? হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ও আল্লামা শাওকানী ছাহেবও কী মাযহাবী মতকে অগ্রাধিকার দিয়ে সহীহ হাদীসকে ধামাচাপা দিলেন?
লা মাযহাবী ভাইদের কাছে একটি প্রশ্ন
এমন কোন সহীহ রেওয়ায়েত দেখান যেখানে বলা হয়েছে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘ডান হাতের যিরা’ বাম হাতের উপর রেখেছেন|
ওয়ায়িল বিন হুজর রা.এর হাদীস ও কতিপয় লা-মাযহাবীদের জঘন্য মিথ্যাচার
মিথ্যা কথা বলা একটি গুরুতর অপরাধ একথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু সেই মিথ্যা যদি হয় হাদীসের নামে তাহলে আর আশ্চর্যের সীমা থাকে না। তাদের এরূপ কর্মকা- আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদীসের কথা। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন
يَكُونُ فِى آخِرِ الزَّمَانِ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ يَأْتُونَكُمْ مِنَ الأَحَادِيثِ بِمَا لَمْ
تَسْمَعُوا أَنْتُمْ وَلاَ آبَاؤُكُمْ فَإِيَّاكُمْ وَإِيَّاهُمْ لاَ يُضِلُّونَكُمْ وَلاَ يَفْتِنُونَكُمْ ».
(সহীহ মুসলিম হাদীস নং-১৬)
হাম্বলী মাযহাবের একটি ফিকহের কিতাব হলো دليل الطالب لنيل المطالب এ কিতাবের শরাহ হলো মানারুস সাবীল। নাসিরুদ্দীন আলবানী সাহেব ইরওয়াওউল গালীল নামে এ কিতাবের হাদীসের তাখরীয করেছেন।
এই মানারুস সাবীল গ্রন্থে সুনানুস সালাহ এর আলোচনায় বলা হয়েছে-
[ووضع اليمين على الشمال، وجعلهما تحت سرته] لحديث وائل بن حجر وفيه ثم وضع اليمنى على اليسرى رواه أحمد، ومسلم. وقال علي رضي الله عنه: إن من السنة في الصلاة وضع الأكف على الأكف تحت السرة رواه أحمد.
লা-মাযহাবীদের মান্যবর আলেম নাসিরুদ্দীন আলবানী সাহেব উক্ত ইরওয়াওউল গালীল গ্রন্থে ২/৬৮ ওয়ায়িল বিন হুজর রা.এর হাদীস তাখরীজ (সুত্র নির্দেশ) করেছেন। নিম্নে তার তাখরীযটি উল্লেখ করা হল।
takhriz 1 takhriz 2
পাঠক উপরের তাখরীজে (সূত্র নির্দেশ) লক্ষ্য করেছেন যে, ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. এর উক্ত হাদীসের মতন ও মূল পাঠের কোথাও বুকের উপর হাত বাধার কথা নেই। অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের কথা না হয় আপাতত থাক। কিন্তু বুখারী ও মুসলিম শরীফের উদ্ধিতিতে তারা বুকের উপর হাত বাধার কথা বলেন কিভাবে ? হাদীসের নামে এত বড় মিথ্যাচার ? আল্লাহ তাদেরকে হিদায়েত দান করুক। এবং দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুক।
বি:দ্র:উল্লেখ্য যে, সহীহ ইবনে খুযায়মায় باب وضع اليمين على الشمال في
الصلاة قبل افتتاح القراءة পরিচ্ছেদে ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা.এর হাদীস
যা মুআম্মাল বিন ঈসমালের সূত্রে (আলা সদরীহীমুনকার অংশযোগে) বর্ণিত হয়েছে। প্রশ্নে যা ইবনে খুযায়মার উদ্ধিৃতিতে আরবী পাঠ সহ উল্লেখ করা হয়েছে। এরই পরবর্তী باب وضع بطن الكف اليمنى على كف اليسرى والرسغ
والساعد جميعا পরিচ্ছেদে ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা.এর আরেকটি হাদীস এনেছেন। সেখানে আলা সদরীহীঅংশটুকু নেই।
কিতাবের হাওলা ও উদ্ধিৃতি দেওয়ার নিয়ম নীতি লঙ্ঘন:
কিতাবের হাওলা ও উদ্ধিৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে শাস্ত্রীয় অনেক নিয়ম কানুন। প্রশ্নে আমরা যে উদ্ধিৃতির বহর দেখতে পাচ্ছি সেখানে সে সব নিয়ম নীতির লংঘন করা হয়েছে চূড়ান্ত মাত্রায়। এমনকি সুস্পষ্ট জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। সচেতন পাঠক এ বিষয়ে অবগত আছেন বলে আলোচনা দির্ঘায়িত হওয়ার আশংকায় সে দিকে আর যাচ্ছি না।
পর্ব-৩
নামাযে বাম কব্জির উপর ডান হাত রেখে দুআঙ্গুল দ্বারা চেপে ধরা সুন্নাত। একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা এ আমল প্রমাণিত। চার মাযহাবের সকল ইমাম ও আলিম এটাকেই সুন্নত পদ্ধতি আখ্যা দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কনুই পর্যন্ত হাত রাখার পক্ষে কোন হাদীস নেই। বুখারী শরীফের যে হাদীসকে এর প্রমাণ স্বরূপ প্রশ্নে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে অপব্যাখ্যা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যার আলোচনা আমরা ইতিপূর্বে করেছি।
পর্ব-৪,৫,৬,৭
হায়াত সিন্ধী রহ. ও লা-মাযহাবীদের দ্বৈত নীতি
লা-মাযহাবী ভাইদের আচরণ বড়ই আশ্চর্যজনক। তারা সাহাবীদের কথাকেই যেখানে দলীল মনে করেন না সেখানে হায়াত সিন্ধী রহ. এর কথাকে দলীল হিসাবে পেশ করেন কিভাবে? কিছু মানুষের বিচ্ছিন্ন মতই কি তাদের একমাত্র পুজি ও মূলধন?
এখানে একটি বিষয় বিষেশভাবে লক্ষ্যযোগ্য। এটি একটি বাস্তবতা যে, ফিকহের ক্ষেত্রে অনেক সময় ফকীহদের যাল্লাত (বিচ্যুত মত) পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে তাফসীরের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় মুফাসসিরীনদের যাল্লাত। ইতিহাসের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদেও যাল্লাত। হাদীসের ক্ষেত্রে রাবীদের যাল্লাত। (যাকে পরিভাষায় ইলমু ইলালিল হাদীস বলা হয়।) এ ধারাবাহিকতার অংশ হিসাবে পরবর্তী আলেমদের মধ্যেও আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামার বিপরীত বিচ্যুত মত পোষণ করতে দেখতে পায়। কোন ব্যক্তির শায বা বিচ্যুত মতকে সংখ্যাগরিষ্ঠ অলেমদের মোকাবেলায় দাড় করানো নীতি বিরুদ্ধ কাজ।
এবার প্রশ্নে উল্লেখিত রেওয়ায়েত সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
রেওয়ায়েত-১.
মুসনাদে আহমদে বিধৃত হযরত হুলব রা.থেকে বর্ণিত বুকের উপর হাত বাঁধার কথাটি শায বা দল বিচ্ছিন্ন বর্ণনা:
(ক). প্রথম কথা হলো এটি বিচ্ছিন্ন বর্ণনা। সুফিয়ান থেকে শুধু ইয়াহইয়াই বুকের উপর হাত বাঁধার কথাটি উল্লেখ করেছেন।
(খ).মুসনাদে আহমদে ওয়াকী রহ., দারাকুতনীতে ওয়াকী ও আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী ও বায়হাকীতে (৩৬১০) আল হুসাইন ইবনে হাফস তিন জন সুফিয়ান থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাদের বর্ণনায় বুকের উপর হাত বাধার কথা নেই।
(গ). তিরমীযী, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদে সুফিয়ানের সঙ্গী আবুল আহওয়াস ও মুসনাদে আহমদে ৫/২২৬(নং২২৩১৬) শরীক ইবনে আব্দুল্লাহ উস্তাদ সিমাক থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বুকের উপর হাত বাধার কথা নেই। সুতরাং এটি শায বা দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা, যা গ্রহণযোগ্য নয়।
রেওয়ায়েত-২.
فصل لربك وانحر আয়াতের ব্যাখ্যা এবং
বুকের উপরের অংশে থুতনীর নিচে হাত রাখা সম্পর্কে গায়রে মুকাল্লিদ আলিম শায়খ বকর বিন আবদুল্লাহ আবু যায়েদ এর বক্তব্যঃ
সমসাময়িক গায়রে মুকাল্লিদ আলিমরাও এই নিয়মকে খন্ডন করেছেন। শায়খ বকর বিন আবদুল্লাহ আবু যায়েদ ‘‘লা জাদীদা ফী আহকামিস সালাহ’’ পুস্তিকায় আরো কিছু নতুন নিয়মের সাথে এ নিয়মটিকেও খন্ডন করেছেন। ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘আমরা দেখেছি, কিছু লোক কোনো শায ও বিচ্ছিন্ন মত গ্রহণ করে তার প্রচারে কিংবা কোনো দুর্বল রুখসত ও অবকাশ গ্রহণ করে তার প্রতিষ্ঠায় সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। এদের খন্ডনের জন্য মনীষী আলিমদের এই নীতিই যথেষ্ট যে, ‘ইলমের ক্ষেত্রে কোনো বিচ্ছিন্ন মত এবং (বিধানের ক্ষেত্রে) কোনো অপ্রমাণিত অবকাশ সম্পূর্ণ বর্জনীয়।
‘কিন্তু সম্প্রতি যে দলটির উদ্ভব ঘটেছে, তাদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, মুসলমানদের প্রতিদিনের ইবাদত-বন্দেগীর ওয়াজিব-মুস্তাহাব বিষয়ে, যে ইবাদত-বন্দেগী ইসলামের মহান নিদর্শন ও প্রতীকও বটে, এমন সব ধারণার
বিস্তার ঘটছে যেগুলোর সাথে কোনো যুগে আলিমসমাজের কোনো পরিচিতি ছিল না। অতিনমনীয় ভাষায় বললে, এসব ধারণার কোনো কোনোটির সূত্র হচ্ছে বহুকাল আগের বর্জিত কিছু মত।
‘আর কোনো ধারণা পরিত্যক্ত হওয়ার জন্য তো এ-ই যথেষ্ট যে, তা সকল আলিমের মতামত থেকে বিচ্ছিন্ন।
‘ইসলামের দ্বিতীয় রোকন নামাযের ক্ষেত্রেও এমন নতুন কিছু কাজ ও অবস্থা আবিষ্কার করা হয়েছে, যার কোনোটা নামাযীকে একটা অস্বাভাবিক রূপ দান করে, অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সম্পর্কে বলেছেন-
وما انا من المتكلفين
‘… এবং আমি ভনিতাকারীদের
অন্তর্ভুক্ত নই।’-সূরা সোয়াদ (৩৮) : ৮৬
‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
بعثت بالحنيفية السمحة
‘তেমনি তা নামাযীর মাঝে একটা উদ্যত ভঙ্গি সৃষ্টি করে, অথচ নামায হচ্ছে আপন রব ও মাবুদের সামনে বান্দার বিনয় ও অক্ষমতার অবস্থা!
‘কোনো কোনো ধারণার অর্থ দাঁড়ায়, ইসলামের প্রথম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত গোটা মুসলিম উম্মাহ ছিল সুন্নাহ বর্জনকারী ও সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত। অন্যভাষায়, তারা ছিল সম্মিলিতভাবে পাপী ও অপরাধী।
‘তো এই সকল ভ্রান্তির কারণ কী?
‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে সুন্নাহ বোঝার ক্ষেত্রে অতিশয়তা, আর কখনো (আরবী) ভাষার বাকরীতি ও হাদীস-ফিকহের মূলনীতি সম্পর্কে উদাসীনতা।
‘এই সকল বিভ্রান্তি হচ্ছে দলীলের বিষয়ে মূলনীতি বর্জনের এবং নামাযের স্বাভাবিক অবস্থা ও ফিকহ-খিলাফিয়াতের কিতাব থেকে বিমুখতার কুফল। অথচ ঐ সকল কিতাবে আহকাম ও বিধানের তত্ত্ব, কারণ ও বিশেষজ্ঞদের মতভিন্নতার আলোচনা থাকে। …’-লা জাদীদা ফী আহকামিস সালাহ পৃ. ৩-৪
বুকের উপরের অংশে গলদেশে হাত বাঁধার ‘দলীল’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা কুরআন মজীদের আয়াত-
فصل لربك وانحر
-এর তাফসীরে আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণনা করা হয়। বায়হাকী তা বর্ণনা করেছেন (২/৩১) এবং তার সূত্রে তাফসীরের বিভিন্ন কিতাবে তা বর্ণিত হয়েছে। যেমন দেখুন : আদ্দুররুল মানছূর ৮/৬৫০-৬৫১
‘এই রেওয়ায়েত সহীহ নয়। কারণ এর সনদে রওহ ইবনুল মুসাইয়াব আলকালবী নামক একজন রাবী আছেন। তার সম্পর্কে দেখুন : আলমাজরূহীন ১/২৯৯
সূরায়ে কাওসারের ঐ আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে সঠিক কথা এই যে, তার অর্থও তা-ই যা নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে-
قل ان صلاتى ونسكى ومحياى ومماتى لله رب العالمين
(বল, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহর জন্য, যিনি রাববুল আলামীন।’
অর্থাৎ ঐ আয়াতে وانحر অর্থ কুরবানী, গলদেশে হাত রাখা নয়।)
‘ইবনে জারীর এই তাফসীরকেই সঠিক বলেছেন এবং ইবনে কাছীর তা সমর্থন করেছেন। তাঁর
মন্তব্য-এটি অতি উত্তম (ব্যাখ্যা)।’-লা জাদীদা ফী আহকামিস সালাহ, বকর আবু যায়েদা পৃ. ৯
রওহ ইবনুল মুসাইয়্যাব সম্পর্কে জরাহ তা’দীলের ইমামদের মন্তব্যঃ
রওহ ইবনুল মুসাইয়্যাব সম্পর্কে ইবনে হিববান রাহ. (৩৫৪ হি.) বলেন, ‘সে ছিকা রাবীদের সূত্রে মওযু রেওয়ায়েত বর্ণনা করে। তার থেকে বর্ণনা করা বৈধ নয়।’
يروي الموضوعات عن الثقات لا تحل الرواية عنه
-কিতাবুল মাজরূহীন
ইবনে আদী বলেন, ‘সে ছাবিত ও ইয়াযীদ আররাকাশী থেকে এমন সব রেওয়ায়েত বর্ণনা করে, যা মাহফুয নয় (সঠিক নয়)।’
يروي عن ثابت ويزيد الرقاشي أحاديث غير محفوظة
-আলকামিল ফী জুয়াফাইর রিজাল ৩/১৪৩
আরো দেখুন : মীযানুল ইতিদাল ২/৫৭; লিসানুল মীযান ২/৪৬৮
সারকথা : এই রেওয়ায়েত নির্ভরযোগ্য নয়। আর এর দ্বারা উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর করা তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আয়াতের সঠিক তাফসীর তা-ই যা ইবনে জারীর তাবারী রাহ. গ্রহণ করেছেন এবং ইবনে কাছীর যাকে ‘অতি উত্তম’ বলেছেন।
হায়াত সিন্ধী রহ. تحت السرة অংশটি সম্পর্কে যা বলতে চেয়েছেন-
আলহামদুল্লিাহ! হায়াত সিন্ধী রহ. বিরচিত ফতহুল গফুর ফী ওয়াজয়িল আয়দী আলাস সুদুরগ্রন্থটি আমরা আদ্যপান্ত পাঠ করেছি। এ পুস্তিকায় তিনি মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বায় উল্লেখিত ওয়ায়েল ইবনে হুযর রা.এর হাদীসের تحت السرة অংশটি নিয়েই মৌলিকভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর কাছে বিদ্যমান নুসখায় تحت السرة অংশটি তিনি পান নি এটাই তিনি বলতে চেয়েছেন। এবং এমতকেই তিনি তাঁর গবেষণায় প্রমাণসিদ্ধ করতে চেয়েছেন। তবে নাভীর নিচে হাত বাধা যাবে না বা এ আমলটি করা ভুল এমন কোন কথা আমরা এ গ্রন্থের কোথাও খুজে পাইনি।
হায়াত সিন্ধী রহ. এর দাবী ও বাস্তবতা:
ওয়ায়েল ইবনে হুযর রা.এর হাদীসের تحت السرة অংশটি শুধু কাসেম ইবনে কুতলুবুগা রহ. এর পান্ডুলিপিতেই শুধু নয়, বরং তা মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবার একাধিক পান্ডুলিপিতে রয়েছে। এর মধ্যে ইমাম মুরতাযা আযাবীদী-এর পান্ডুলিপি ও ইমাম আবিদ আসসিন্দী রাহ.-এর পান্ডুলিপি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম কাসিম ইবনে কুতলূবুগা রাহ., আল্লামা আবদুল কাদির ইবনে আবু বকর আসসিদ্দীকি ও আল্লামা মুহাম্মাদ আকরাম সিন্ধীর পান্ডুলিপিতেও হাদীসটি এভাবে আছে। পক্ষান্তরে অন্য কিছু পান্ডুলিপিতে এই বর্ণনায় تحت السرة (নাভীর নিচে) কথাটা নেই। এ কারণে ভারতবর্ষে মুদ্রিত মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবার পুরানো সংস্করণে এই হাদীসে تحت السرة (নাভীর নিচে) অংশটি ছিল না। বর্তমানে মদীনা মুনাওয়ারার বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামার তাহকীক-সম্পাদনায় মুসান্নাফের যে মুদ্রণ পাঠক-গবেষকদের কাছে পৌঁছেছে তাতে হাদীসটি تحت السرة (নাভীর নিচে) অংশসহ রয়েছে। কারণ শায়খের সামনে প্রথমোক্ত পান্ডুলিপি দুটিও ছিল। এ বিষয়ে
বিস্তারিত আলোচনার পর শায়খ বলেন-
ومن نقل الحديث من إحدى النسخ الأربع خ. ظ. ن. ش. التي ليست فيها هذه الجملة : معذور في عدم إثبات هذه الزيادة، ولكنه ليس معذورا في نفي ورودها، ومن نقله عن إحدى النسختين اللتين فيهما هذه الزيادة هو معذور في إثباتها، بل واجب عليه ذلك ولا يجوز لها حذفها فعلى م التنابز والتنابذ؟
উৎসাহী আলিমগণ শায়খের পূর্ণ আলোচনা মুসান্নাফের টীকায় দেখে নিতে পারেন।
অতএব প্রমাণিত হল যে, ওয়ায়েল ইবনে হুজর রা. এর হাদীসে ‘তাহতাস র্সুরাহ’ অংশটি কল্পনাপ্রসূত নয়। বরং দলীল সমৃদ্ধ। এর পক্ষে যেমন রয়েছে আমলে মুতাওয়ারাস তেমনি সাহাবী ও তাবেয়ীদের আমল।
তাউসের মুরসাল সম্পর্কে কিছু কথা:
ক) পয়লা কথা হলো- তারা নিজেরাই মুরসালকে প্রামাণ্য করেন না।
খ) এর সনদে সুলায়মান ইবনে মুসা নামের একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন। তার সম্পর্কে জরাহ-তাদীলের ইমামদের অনেক আপত্তিকর মন্তব্য রয়েছে। তন্মধ্যে শুধুমাত্র দুটি মন্তব্য উল্লেখ করা হলো-
১.তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেছেনعنده مناكير তার কিছু আপত্তিকর বর্ণনা আছে।
২.ইমাম নাসায়ী বলেছেন- ليس بالقوى فى الحديث তিনি হাদীসে মজবুত নন। (দ্র, যাহাবীর আল কাশিফ)
৩.তিনি মুদাল্লিস রাবী। এটি স্বীকৃত কথা যে, মুদাল্লিস রাবী যদি عن (হতে বা থেকে) শব্দ যোগে বর্ণনা করেন, তবে সেটি অবিচ্ছিন্ন সূত্র বলে বিবেচিত হয় না। এ দিক বিচারে সুলায়মান ও তাউসের মাঝে আরেকটি বিচ্ছিন্নিতা সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া এ রেওয়ায়েত দুটি মৌলিক কারণে মা’লুল।
এক. রেওয়ায়েতটি মুরসাল এবং এর সমর্থনে অন্য সনদে বর্ণিত কোনো মারফূ হাদীস বা আছর পাওয়া যায় না। ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর হাদীসের মুয়াম্মাল ইবনে ইসমাইল এর বর্ণনা এবং হুলব রা. এর হাদীসের মুসনাদে আহমদের বর্ণনাকে এর সমর্থনে পেশ করা হয়, কিন্তু ইতিপূর্বে দেখানো হয়েছে যে, এ দুটো বর্ণনা শায ও মুনকার। আর শায, মুনকার রেওয়ায়েত শাহিদ (সমর্থক বর্ণনা) হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
দুই. মুসলিম জাহানের কোনো প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুজতাহিদ ইমাম বুকের উপর হাত বাঁধাকে সুন্নাহ বলেছেন এমনটা পাওয়া যায় না। এমনকি শাম অঞ্চলের বিখ্যাত ফকীহদের থেকেও পাওয়া যায় না। অথচ উপরোক্ত মুরসাল রেওয়ায়েতের সবকজন রাবী শাম ও শামের নিকটবর্তী অঞ্চলের এবং অধিকাংশ রাবীরই ফকীহ-পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু না শামের ফকীহগণ বুকের উপর হাত বাঁধার ফতোয়া দিয়েছেন, না শামের সাধারণ আলিমগণ এই নিয়মের সাথে পরিচিত ছিলেন। এটি এ রেওয়ায়েতের একটি ‘ইল্লত’ (ত্রুটি), যাকে পরিভাষায় ইল্লতে মান’বিয়্যাহ বা শুযূযে মানবী বলে।
মোটকথা, উপরের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হল যে,, খাইরুল কুরূন ও পরবর্তী যুগের হাদীস-ফিকহের বড় বড় ইমাম নাভির নিচে হাত বাঁধা এই নিয়ম গ্রহণ করেছেন। এঁদের মধ্যে ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী, ইমাম আবু হানীফা, ইমাম সুফিয়ান ছাওরী, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপরন্তু বেশ কিছু মরফূ হাদীসেও নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে।
সুতরাং এটি নামাযে হাত বাঁধার মাসনূন তরীকা। এ সম্পর্কে দ্বিধা ও সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।
হযরত আলী রাঃ এর বর্ণনা ও আমাদের কথা
হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘সুন্নাহ হচ্ছে নামাযে হাতের পাতা হাতের পাতার উপর নাভীর নিচে রাখা।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৮৭৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৭৫৬; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৯৬৬
সনদসহ রেওয়ায়েতটির পূর্ণ আরবী পাঠ এই-
حدثنا محمد بن محبوب، حدثنا حفص بن غياث، عن عبد الرحمن بن إسحاق، عن زياد بن زيد، عن أبي جحيفة أن عليا رضي الله عنه قال : السنة وضع الكف على الكف في الصلاة تحت السرة.
قال المزي في تحفة الأشراف ٨/٤٥٨، هذا الحديث في رواية ابي سعيد بن الأعرابي، وابن داسة وغير واحد عن أبي داود، ولم يذكره أبو القاسم.
এখানে একটি বিষয় ভালভাবে বুঝতে হবে যে, সুনির্দিষ্ট সনদ যয়ীফ হওয়া এক বিষয়। আর বিষয়টিই ভিত্তিহীন কিংবা যয়ীফ হওয়া আরেক বিষয়। অনেকে সুনির্দিষ্ট কোন সনদ যয়ীফ হওয়ার বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে, মনে হয় যেন পুরা বিষয়টিই বাতিল। অথচ এ জাতীয় উপস্থাপন মারাতœক বিভ্রান্তিকর।
আলহামদুলিল্লাহ! ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ! ইতেদালের সর্ব্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হানাফী মনীষীগণ এমন নন যে, তারা কোন বর্ণনার সনদগত দুর্বলতা থাকলে তা অস্বীকার করবেন। বরং তাঁরাও স্বীকার করেন এর সনদে দুর্বলতা থাকলেও এর পক্ষে ও সমর্থনে আমলে মুতাওয়ারাস এবং বিশুদ্ধ মারফু রেওয়ায়েত রয়েছে। এতএব ইমাম বায়হাকী রহ. হযরত আলী রা.এর নাভীর নিচের হাত বাধার যে হাদীস যয়ীফ বলেছেন এর মানে ও উদ্দেশ্য এটা নয় যে, নাভীর নিচে হাত বাধা সঠিক নয়। বরং তিনি কেবল সুনির্দিষ্ট সনদের ব্যাপারে কথা বলেছেন।
পর্ব-৮
হাত বাঁধা ও হাত রাখার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে যেয়ে হানাফী আলেমগণ যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা কী বিদআত?
হাত বাঁধার নিয়ম সম্পর্কিত হাদীসের কোন কোনটি থেকে বুঝা যায় যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাম হাতের উপর ডান হাত রাখতেন। আর কোন কোনটি থেকে বুঝা যায় যে, তিনি ডান হাত দ্বারা বাম হাত চেপে ধরতেন। বাম হাতের কোন জায়গা চেপে ধরতেন? অধিকাংশ হাদীসই প্রমাণ করে, বাম হাতের কব্জি চেপে ধরতেন।
এসব হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে চার মাযহাবের আলিমগন সেই পদ্ধতিকেই অবলম্বন করেছেন যেভাবে হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ আমল করে থাকেন।
হাদীসের অনুসরণে হানাফী আলেমগণ কিভাবে এ সংক্রান্ত হাদীসগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন সে বিষয়ে হালবী রহ.এর বক্তব্য লক্ষ্য করুন। তিনি তাঁর মুনয়াতুল মুসল্লী এর ভাষ্যগ্রন্থে লিখেছেন- অর্থাৎ উল্লিখিত হাদীসগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনকল্পে সুন্নাত হলো হাত রাখা ও বাঁধা দুটির উপরই একসঙ্গে আমল করা। কারণ কিছু হাদীসে চেপে ধরার কথা এসেছে। কিছু হাদীসে হাতকে হাতের উপর রাখার কথা এসেছে। আর কিছু হাদীসে বাহুর উপর হাত রাখার কথা এসেছে। এগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের পদ্ধতি হলো, ডান হাতের তালু বাম হাতের পিঠের উপর রাখবে, বৃদ্ধাঙ্গুলি ও কনিষ্ঠা আঙ্গুলি দ্বারা কব্জি চেপে ধরবে, আর বাকি তিন আঙ্গুল বাহুর উপর বিছিয়ে দিবে। তাহলে হাতের উপর হাত রাখা, বাহুর উপর হাত রাখা এবং ডান হাত দ্বারা বাম হাত চেপে ধরা, সবগুলোই হাসিল হবে। (শরহু মুনয়াতুল মুসল্লী)
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. এর প্রতি মিথ্যা অভিযোগ
নাভীর উপরে হাত বাধা আর বুকের উপর হাত বাধা এক জিনিস নয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সিফাতুস সালাহ গ্রন্থের টীকায় ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. এর বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে মনে হয় যেন তিনিও বুকের উপর হাত বাধাকে সমর্থন করেছেন। অথচ বিষয়টি এর বিপরীত। এ বিষয়ে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. এর সুস্পষ্ট বক্তব্য আলবানী সাহেবের চিন্তাধারাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে। হাম্বলী মাযহাবের শীর্ষ আলেম ইবনে মুফলিহ তার আল ফুরু গ্রন্থে লিখেছেন, ويكره وضعها على صدره نص عليه
বুকের উপর হাত রাখা মাকরুহ। আহমদ রহ. একথা স্পষ্ট করেই বলেছেন। ইমাম আবু দাউদ ইমাম আহমদ থেকে এ ফতোয়া উল্লেখ করেছেন যে,
فوق السرة قليلا وإن كان تحت السرة فلا بأس به .
হাত নাভীর সামান্য উপরে রাখবে, নাভীর নীচে রাখলেও কোন অসুবিধা নেই। (দ্র.মাসাইলে আহমদ, লি আবী দাউদ, ১/৪৮)
ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহি সম্পর্কে আলবানী মরহুমের দাবীর অসারতা
প্রশ্নে উল্লেখিত ইসহাক ইবনে রাহওয়াই রহ.এর বক্তব্য এবং এর সঠিক মর্মার্থ:
মারওয়াযী তার আল মাসায়েল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-
فقد ذكر المروزي في ( المسائل ) ( ص 222 ) : ( كان إسحاق يوتر بنا . . . ويرفع يديه في القنوت ويقنت قبل الركوع ويضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين ).
ইবারতটির সঠিক অর্থ: —তিনি কুনুতের সময় উভয় হাত বুক বরাবর বা বুকের নীচ পর্যন্ত ওঠাতেন।
আর জানা কথা বুকের নীচে রাখলে তো আলবানী সাহেবের মতলব প্রমাণিত হয় না।
একই গ্রন্থে ইসহাক ইবনে রাহাওয়াই রহ. সুস্পষ্ট বক্তব্য (تحت السرة أقوى في الحديث وأقرب إلى التواضع (অর্থাৎ নাভির নীচে হাত বাঁধার হাদীস অধিক শক্তিশালী এবং বিনয়ের নিকটতর- মাসাইলুল ইমাম আহমদ ওয়া ইসহাক, লি ইসহাক ইবনে মানসুর আল কাওসাজ, নং ২১৪.) তিনি কেন এড়িয়ে এলেন তা রহস্যময় নয় কী ?
আলবানীর দাবীর খ-নে মনীষীদের বক্তব্য:
খন্ডন ১
ইসহাক ইবনে রাহাওয়াই রহ. এর উক্ত বক্তব্য যে তার দাবীর প্রমাণ বহন করে না তা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন হাসান বিন আলী আসসাক্কাফ তার ‘তানকুযাতুল আলবানী’ গ্রন্থে । তিনি বলেন-
وأما احتجاج المتناقض ! ! (المومى إليه !) بفعل إسحق بن راهويه حيث قال : (وقد عمل بهذه السنة الامام إسحق بن راهويه) ! !
فاحتجاج باطل مهدوم من وجهين : الاول : أنه لم يثبت أن إسحق وضعهما على ثدييه ! ! بل جاء في النص الذى نقله هذا المتناقض ! ! عن المروزى أن إسحق (كان يضع يديه على ثدييه أو تحت الثديين) فقول المروزى فيه : (أو تحت الثديين) يهدم استدلال هذا المتناقض ! ! من أساسه لانه لا طائل من وراء استدلاله إذ أن تحت الثديين هو ما قررناه وهو عند السرة ! ! وإذا طرأ الاحتمال سقط الاستدلال ! ! الثاني : أنه لا عبرة بالتشبث بأقوال الرجال ! ! فاعرف الحق تعرف أهله أيها المتناقض ! ! وإذا كنت قد نقلت أن إسحق بن راهويه كان يضعهما تحت ثدييه فإننا على استعداد تام أن ننقل لك عن عشرات الائمة من السلف أنهم كانوا يضعونها تحت السرة وليس (كما يفعل المتناقض ! ! هو ومن على شاكلته من المتمسلفين ! !) ! ! وفي نقل الترمذي كلام السلف في ذلك عبرة لمن يعتبر ! ! على أن الامام الحافظ النووي رحمه الله تعالى نقل في
(شرح المهذب) (3 / 313) وابن قدامة في (المغني) (1 / 519) أن مذهب إسحاق هو وضعهما تحت السرة ! ! ونقلهما الفقهى أوثق من نقل المروزى ولو صح إسناده ! ! فاستيقظ ! !
খন্ডন
মাসাইলে ইমাম আহমদ ও ইসহাক গ্রন্থটির টীকাকার বলেন-
معنى كلام الكوسج أن إسحاق بن راهويه يرفع يديه في حال القنوت بإزاء ثدييه أو بإزاء تحتهما، أي أنه يرفعهما إلى صدره، لا أنه يضعهما مباشرة على الثديين أو تحتهما. بدليل أن ابن قدامة في المغني: 2/584 ذكر رأي الإمام أحمد في هذه المسألة، وهو أنه يرفع يديه في القنوت إلى صدره، ثم قال: وبه قال إسحاق. ولأن إسحاق -رحمه الله- لا يرى وضع اليدين على الصدر حتى ولا في حال القيام في الفريضة، بل يرى وضعهما تحت السرة، كما روى ذلك عنه الكوسج في المسألة رقم (214) قال: قال إسحاق: كما قال، تحت السّرّة أقوى في الحديث، وأقرب إلى التوضع.
وعلى هذا فقول الألباني -رحمه الله- في إرواء الغليل 2/71، 72: “والذي صح عنه صلى الله عليه وسلم في موضع وضع اليدين إنما هو الصدر، وفي ذلك أحاديث كثيرة… وأسعد الناس بهذه السنة الصحيحة الإمام إسحاق بن راهويه، فقد ذكر المروزي في المسائل ص 222: كان إسحاق يوتر بنا… ويرفع يديه في القنوت ويقنت قبل الركوع، ويضع يديه على ثدييه، أو تحت الثديين”. فيه نظر ولا يساعد عليه السياق، والله أعلم.
(দ্র.শামেলা ভার্সন)
সারকথা: আলবানীর উদ্ধৃত কথাটির অর্থ এই নয় যে, ইসহাক রহ. নামাযে বুকের উপর হাত বাঁধতেন। বরং এর অর্থ হলো তিনি দোয়ায়ে কুনুত পড়ার সময় যে হাত উঠাতেন তা বুক বরাবর বা বুকের নীচ পর্যন্ত ওঠাতেন।
খন্ডন ৩
আধুনিক কালে আরবের বড় গবেষক ড.মাহের ইয়াসীন আল ফাহল তার আছারু ইখতিলাফিল মুতুন ওয়াল মাসানীদ ফী ইখতিলাফিল ফুকাহা’ নামক গ্রন্থে স্পষ্ট বলেছেন-
نسبة الألبانى لإسحاق بن راهويه و لا يصح عنه .
অর্থাৎ আলবানী সাহেব বুকের উপর হাত বাঁধাকে ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ এর আমল আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এটা তার থেকে প্রমাণিত নয়। (দ্র.২/১৮, শামেলা ৬০০০ ভার্সন)
والله اعلم بالصواب
 
Top